21.2 C
Düsseldorf

ঋজুদা ছিলেন, ঋজুদা আছেন, ঋজুদা থাকবেনও

Must read

উপমন্যু রায়
উপমন্যু রায়
পেশায় সাংবাদিক। নেশা সাহিত্য। বর্তমানে একটি দৈনিক পত্রিকা‌য় কর্মরত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম কম এবং বাংলাভাষা ও সাহিত্যে এম এ। তবে স্বপ্ন ও মননে রয়েছে কথাসাহিত্য। মানসিক দিক থেকে নিঃসঙ্গতা–প্রিয়। প্রিয় বিষয় পরাবাস্তব। প্যারাসাইকোলজি ও অ্যানসিয়েন্ট এলিয়েন নিয়ে আগ্রহ অসম্ভব। তাই পৃথিবী ও পৃথিবীর বাইরের জগৎ সম্পর্কে নিজস্ব ধারণাও রয়েছে। সেই ধারণার সঙ্গে আমাদের চোখের সামনের বাস্তবতা মিলিয়ে সৃষ্টি করেন নতুন ভাবনা, যা তঁার লেখায় দেখা যায়। এ বিষয়ে তঁার উল্লেখযোগ্য বই (‌১)‌ ‘অশরীরী আতঙ্ক/ পৃথিবীর রহস্যময় ঠিকানা’, (‌২)‌ গভীর রাতের আতঙ্ক (‌পাঁচটি অতিপ্রাকৃত উপন্যাসের সংকলন)‌, এবং (‌৩)‌ প্রেত রহস্য / মোটেও কল্পকাহিনি নয়। কল্পনা ও আবেগকে অসম্ভব গুরুত্ব দেন। তঁার কথায়, ‘‘যতদূর পারো, কল্পনা করো। কারণ, বিশ্বসংসারে অবাস্তব বলে কিছু হয় না।’’ আর আবেগ সম্পর্কে তঁার বক্তব্য, ‘‘আবেগ ফুরিয়ে গেলে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে যায়।’’ উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘‌নারী, তোমাকে’‌, ‘তার পর বৃষ্টির শব্দ’, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’, ‘তার পর অন্ধকার আরও’, ‘অন্ধকারের পিছনে’, ‘স্বপ্ন, শূন্যতা এবং’, ‘মুখোমুখি মৃত্যু তখন’, ‘তারা আসছে’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য গল্প রাতের সমুদ্র, সমুদ্র উত্তাল, সমুদ্রের দিনরাত, সমুদ্রের শূন্য শহর, সমুদ্রে অদ্রিজা, বিকেলের মৃত্যু প্রভৃতি।

অরণ্য বা প্রকৃতি প্রেমিক সাহিত্যিকের অভাব নেই বাংলা সাহিত্যে। তেমনই অরণ্যকে পটভূমি করে উপন্যাসও তো কম লেখা হয়নি বাংলায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ বা ‘আরণ্যক’ কিংবা হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘আবার যখের ধন’ উপন্যাসের কথা বাঙালি কি সহজে ভুলতে পারবে?

বুদ্ধদেব গুহ

তবে বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন সকলের মধ্যে একেবারেই অন্য রকম। তিনি শুধু যে অরণ্যকে ভালবেসেছেন, তা–ই নয়, তিনি অরণ্যকে নিজের সৃষ্টিতে এমন ভাবে ধারণ করেছেন, তা অন্য আর কোন সাহিত্যিকের মধ্যে দেখা গিয়েছে, সে কথা বলতে গেলে থমকে যেতে হবে। তিনিই সেই বাঙালি সাহিত্যিক, কলমের মতো যাঁর বন্দুকও কথা বলত!‌ হ্যাঁ, তিনি নিজে বহুবার শিকারে গিয়েছেন। শুধু ভারতে নয়, সুদূর আফ্রিকার দুর্ভেদ্য অরণ্যেও। বাঘ বা বন্যপশু শিকার নিষিদ্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত ব্যক্তিগত জীবনেও ভারতের বিভিন্ন জঙ্গলে বহুবার শিকারে গিয়েছেন। আফ্রিকার ভয়ঙ্কর অরণ্যগুলিতেও বন্দুক হাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অনেকবার। বন্যপ্রাণীদের স্বভাব–বৈশিষ্ট্য, সব কিছু ছিল তাঁর জানা।

অব্যর্থ নিশানা ছিল তাঁর বন্দুকের। বন্দুক ভালো চিনতেনও। বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য বন্দুক ছিল তাঁর সংগ্রহে। ভারতই বলুন, বা পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ— কোথাও নতুন ধরনের বন্দুক পাওয়া গেলেই তিনি সংগ্রহ করে রাখতেন।
এই প্রসঙ্গে তাঁর বাবার কথাও উল্লেখ করতে হয়। তাঁর বাবাও ছিলেন নামজাদা শিকারি। তাঁর সংগ্রহেও ছিল বহু আধুনিক বন্দুক। অর্থাৎ, ছেলেবেলা থেকেই বুদ্ধদেব অরণ্য এবং বন্যপশুর নাড়িনক্ষত্র জেনে গিয়েছিলেন। তার পর বড় হয়ে তো অরণ্যকে নিজের করে নিয়েছিলেন। অরণ্যে গেলে কোনও এক খেয়াল যেন চেপে বসত তাঁর মাথায়। হারিয়ে যেতেন কাউকে কিছু না বলে। তেমন অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছিলেন স্বয়ং সমরেশ মজুমদারও। জলপাইগুড়ির মধু চা–বাগানে বুদ্ধদেব গুহর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘তাঁকে পাওয়া গেল একটি ঝুপড়ির মধ্যে। স্যুট পরে খাটিয়ায় কাউকে শুয়ে থাকতে এর আগে কখনও দেখিনি!’’ ঘুরতে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। অবশ্যই প্রথম পছন্দ ছিল অরণ্য। তবে অন্য সব জায়গায়ও যেতেন। যেমন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স তো বটেই, ইউরোপের সমস্ত দেশ, এ ছাড়া আমেরিকা, কানাডা, জাপান, হাওয়াই, থাইল্যান্ড, মায়ানমার ছাড়াও গোটা পূর্ব আফ্রিকা ছিল তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। গিয়েছেন আফ্রিকার দুর্গম অরণ্যগুলিতেও।

বুদ্ধদেব গুহআর সে সব কথাই উঠে এসেছে তাঁর সৃষ্টি ঋজুদার কাহিনিগুলিতে। হয়তো ঋজুদার আড়ালে ওইসব কাহিনিতে নিজের ছবিই এঁকেছিলেন তিনি। কোনও জন্তুজানোয়ার বা প্রাণীকে ভয় পেতেন না। তাঁর ঋজুদা এবং ঋভুর কথা জানেন না, এমন পাঠক বাংলা সাহিত্যে হয়তো কমই আছেন। গুগুনোগুম্বারের দেশে, অ্যালবিনো, রুআহা, নিনিকুমারীর বাঘ, বনবিবির বনে, টাঁড়বাঘোয়া, বাঘের মাংস, বনবিবির বনে, ল্যাংড়া পাহান, কাঙ্গপোকপি, ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো, ডেভিলস আইল্যান্ড, জুজুমারার বাঘ, হুলুক পাহাড়ের ভালুক, মোটকা গোগোই, অরাটাকিরির বাঘ, ফাগুয়ারা ভিলা, ছোটিডোঙ্গরির চিতা, কেশকালের বাঘিনী, লিলি সিম্পসনের বাঘ— কত নাম করব?

ঋজুদা সমগ্র প্রকাশ করেছে আনন্দ পাবলিশার্স। তবে তাদের পাঁচটি খণ্ডে সম্ভবত সমস্ত ঋজুদাকে ধরা যায়নি। কারণ, আরও কত পত্রপত্রিকায় ঋজুদা যে ছড়িয়ে রয়েছে, তার হিসেব নেই। অরণ্য, বন্যপশু এবং শিকার তঁার সমস্ত লেখায় অতিস্বাভাবিক ছবি হয়ে উঠে এসেছে, যে কারণে পাঠক বিনাদ্বিধায় ডুবে যেতে পেরেছে তাঁর সৃষ্টিতে। হয়তো তাই শারদ সাহিত্য প্রকাশের সময় এলেই তাঁর অরণ্য জীবনের গন্ধ অনেক দূর থেকে ভেসে আসত বাঙালি পাঠকের কাছে।

হ্যাঁ, এখনও। এখনও মনে হবে সে কথা। কারণ, সত্য হল, ঋজুদার মৃত্যু হয়নি। কেন না, ঋজুদাদের মৃত্যু হয় না। তাই বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদা যেমন ছিলেন, তেমনই আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।


তবে বুদ্ধদেব গুহ আজ অতীত হয়ে গেলেন।
সোমবার (‌৩০ অগস্ট)‌ সকালে ঘুম ভাঙতেই খবরটা পাই। আমার কর্মস্থল আজকাল পত্রিকা দফতরের সহকর্মী স্বরূপদার (‌স্বরূপ গোস্বামী)‌ একটা এসএমএস দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ‘বুদ্ধদেব গুহ চলে গেলেন’। সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছিল।

সেই সময়ই ব্যক্তিগত কারণে আমায় ফোন করেছিলেন ‘নাপৃথিবী’ গ্রুপের সম্পাদক স্মৃতিকণা রায়। তিনি বুদ্ধদেব গুহর প্রয়াণের খবরটা জানতেন না। আমার কাছ থেকে শুনে প্রায় কেঁদেই ফেললেন। বললেন, ‘‘কী বলছিস তুই!’’
আসলে বেশ কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণ কলকাতায় তাঁর সানি টাওয়ার্সের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কখনও তিনি অসুস্থ, কখনও বা কলকাতায় না থাকা, আবার কখনও সময়–অসময়ের দ্বন্দ্বে আমাদের যাওয়া হয়ে উঠছিল না। তার পর তো করোনা–সময় শুরু হয়ে গেল। দু’বছর ধরে এই সময় সকলকেই কোণঠাসা করে দিয়েছে। তাই আর বুদ্ধদেব গুহর কাছে গিয়ে উঠতে পারিনি।

স্মৃতিকণাও অনুযোগ করলেন, ‘‘তুই সময় করতে পারলে আর একটু উদ্যোগী হলে তাঁর সঙ্গে আমাদের একটা আলোচনা হতেই পারত। কত কথা জানার ছিল তাঁর কাছ থেকে!’’ সত্যিই তাই। একই কথা বলল সাবিনাও। সাবিনা ইয়াসমিন। সকালেই ফোন করেছিল। দুঃখ করে বলল, ‘‘তোমাকে কতবার বলেছিলাম, মানসদাকে বলে একটা সময় করো, আমরা যাব। তুমি করতেই পারলে না!’’ প্রসঙ্গত বলি, মানসদা মানে মানস ভাণ্ডারী। কর্মসূত্রে দেব সাহিত্য কুটীরের সঙ্গে যুক্ত। আমার প্রিয় সাহিত্যিক। তিনি নিজেদের পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রয়োজনে নিয়মিত বুদ্ধদেব গুহর বাড়ি যেতেন। প্রায় বছর দশেক বুদ্ধদেব গুহকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। তাঁর অনেক না–জানা কাহিনি, ঘটনা তাঁর জানা।

বুদ্ধদেব গুহর লেখা তিনটে বই সম্পাদনা করেছেন তিনি। সেগুলি হল ‘ঋজুদা ঋজুদা’, তাঁর ৫০টি গল্পের সংকলন ‘গল্প পঞ্চাশ’ এবং কিশোরদের জন্য লেখা গল্পগুলির সংগ্রহ ‘কিশোর গল্প’।
দৃষ্টিশক্তির সমস্যা গত বেশ কয়েক বছর ধরে বুদ্ধদেব গুহকে কাবু করে দিয়েছিল। তাই এই সময়ে তাঁর বহু লেখার অনুলিখন করেছেন মানসদা নিজে। সেই কারণে তাঁর বাড়িতে মানসদার ছিল অবাধ যাতায়াত। এমনকী, বুদ্ধদেব গুহর নানা মুহূর্তের বহু ছবি নিজের মোবাইল–বন্দি করেছিলেন মানসদা। কিন্তু সেই মোবাইল আচমকাই খারাপ হয়ে যাওয়ায় ছবিগুলিও হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো। সে কথা মনে করে আক্ষেপ করছিলেন মানসদা।
বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছের কথা তাঁকে বলেওছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘‘বুদ্ধদেববাবু এখন সবার সঙ্গে দেখা করেন না। তবু কবে যাবে বোলো। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে সময় ঠিক করে দেব।’’
কিন্তু সেই সময়টাই বের করা হয়ে উঠল না। আর হবেও না কোনও দিন। এই আক্ষেপ আমার আমৃত্যু থেকে যাবে।


ব্যক্তিগত ভাবে বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে আমার গভীর একটা মানসিক যোগাযোগ ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, আমার কৈশোরকে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছিল তাঁর লেখা একটি উপন্যাসই। উপন্যাসটার নাম ছিল ‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’। বইটা প্রকাশিত হয়েছিল আমার পড়ার অনেক–অনেকদিন আগেই। তবে আমি পড়েছিলাম স্কুলে পড়ার সময় লাইব্রেরি থেকে নিয়ে। বেশ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম তখন। একটা স্বপ্নের জগতে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল উপন্যাসটা। সেই ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল। কিন্তু তাঁর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ঋজুদাকে দিয়ে।

তখন সন্তু–কাকাবাবুই ছিল আমার প্রিয় চরিত্র। এ ছাড়া হৃদয়ের কাছাকাছি ছিল ঋজুদা। খুব ভালো লাগত প্রফেসর শঙ্কু এবং গোগোল। তবে, ঋজুদা, নাকি সন্তু–কাকাবাবু আমার বেশি প্রিয়, তা নিয়ে মাঝে মাঝে দ্বন্দ্বে পড়ে যেতাম। একবার দু্ষ্টুমি করে তাঁকে আমার কথা খোলাখুলি লিখেও দিয়েছিলাম। মনে আছে, একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সোজা তাঁর ঠিকানায়। লিখেছিলাম, ‘‘আপনার ঋজুদা আমার প্রিয়। তবে আমার বেশি ভালো লাগে সন্তু–কাকাবাবুই।’’

লিখে একটু ভয়ই হয়েছিল। কী জানি কী ভাববেন তিনি! কী ভেবেছিলেন জানি না, তবে আমাকে স্তম্ভিত করে উত্তর দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘‘তুমি আমার ঋজুদার সব কাহিনি পড়োনি মনে হয়। এবার পড়তে শুরু করো। দেখো, সেগুলিও তোমার আরও বেশি ভালো লাগবে।’’ সন্দেহ নেই ইঙ্গিতবহ এবং বুদ্ধিদীপ্ত চিঠি! সেই সময় চিঠিটা পেয়ে কী যে আনন্দ হয়েছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না। বহুদিন চিঠিটা আগলে রেখেছিলাম। তবে শেষ রক্ষা করতে পারিনি।

আজ খুব দুঃখ হচ্ছে, সেই চিঠিটা আমার সংগ্রহে নেই। সারা জীবনে আমার স্বভাবদোষে অনেক মূল্যবান জিনিস যেমন আমি হারিয়েছি, এই চিঠিটাও তেমন ভাবেই হারিয়ে গিয়েছে। যতদূর মনে পড়ে, বেশ সুন্দর হাতের লেখা ছিল তাঁর। একটু টানা লেখা। অবশ্য স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। চিঠিটা সংগ্রহে রাখতে পারলে আমার কাছে একটা সম্পদ হয়ে থাকত!


বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি ছিলেন সত্যিকারের অভিজাত পুরুষ। বংশগরিমা থেকে আভিজাত্য, লেখাপড়া থেকে সংস্কৃতি চেতনা, সব ক্ষেত্রে তাঁর ঔজ্জ্বল্য ছিল অসম্ভব বেশি। শারীরিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি দীপ্ত ব্যক্তিত্ব যে কোনও জায়গায় তাঁকে সকলের মধ্যে স্বতন্ত্র করে তুলত। তিনি যেন অবলীলায় হয়ে উঠতেন নক্ষত্র বিশেষ।
ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারীও। যেমন দেখতে ছিলেন, তেমনই ছিল তাঁর লেখাপড়া। ছিলেন পশ্চিমবাংলার একজন নামি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। কলকাতায় ছিল তাঁর বিশাল চাটার্ড ফার্ম। আবার, দিল্লির কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড তাঁকে বাংলার আয়কর বিভাগের উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিল। এ ছাড়া আকাশবাণী কলকাতা এবং ভারত সরকারের ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্যও হয়েছিলেন।
দারুণ আঁকতেও পারতেন তিনি। নিজের অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ নিজেই এঁকেছিলেন। বলা বাহুল্য, সেইসব বইয়ের প্রচ্ছদ সমালোচকদের সমীহ আদায় করে নিয়েছিল। দরাজ গলায় গান গাইতেন। গায়ক হিসেবেও তাঁর বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। তাঁর স্ত্রী ঋতু গুহও ছিলেন নামি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। দশ বছর আগে তিনি প্রয়াত হন।‌‌ স্ত্রীর মৃত্যু তাঁকে অনেকটাই একা করে দেয়।
ব্যক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন বর্ণময় চরিত্র। অমর্ত্য সেনের প্রথম স্ত্রী নবনীতা দেবসেন ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শোনা যায় নবনীতা দেবের (‌তখন দেব ছিলেন)‌ সঙ্গে তাঁর বিয়ে হওয়ার কথাবার্তা চলেছিল দুই পরিবারে। কী কারণে শেষ পর্যন্ত তা পরিণতির দিকে যায়নি, তা অবশ্য জানা যায় না। আবার বিখ্যাত কবি সুনির্মল বসু ছিলেন বুদ্ধদেব গুহর মামা। অর্থাৎ, সাহিত্য–সংস্কৃতি মিশেছিল তাঁর রক্তেই।


সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁর অন্যতম পরিচয় অরণ্যপ্রেমিক লেখক। তাঁর শিকার কাহিনি কাকে না মুগ্ধ করেছে! তবে সাহিত্যকর্মে অরণ্যানীর জীবন ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর প্রেমিক সত্তা। পশ্চিমবাংলা এবং বাংলাদেশ, দুই বাংলাতেই তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক ছড়িয়ে রয়েছেন। বুদ্ধদেব গুহর প্রেমের গল্প–উপন্যাসগুলি আঁকড়ে থাকতে দেখেছি বহু বাঙালি নারীকে। অনেক মহিলাই নির্দ্বিধায় তাঁকে প্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা দিয়েছেন। ‘বুদ্ধদেব গুহ’ নামটাই যেন অনেক নারীর মনে আলোড়ন তুলে দিত। সে কথা অনেক নারী স্বীকারও করেছেন।

তাঁর লেখা মাধুকরী, কোজাগর, বাংরিপোসির দু’রাত্রির, বাসনাকুসুম, জঙ্গল মহল, নগ্ন নির্জন, পলাশতলির পড়শি, পরিযায়ী, অববাহিকা, আয়নার সামনে, চবুতরা, ছৌ, বাতিঘর তো বহু আলোচিত উপন্যাস। এ ছাড়া তাঁর বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল একটু উষ্ণতার জন্য, চানঘরে গান, বাজে চন্দনপুরের কড়চা, চারকন্যা, পাখসাট, গুঞ্জাফুলের মালা, ওয়াইকিকি, এক ঘরের দুই রাত প্রভৃতি। ‘হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৬ সালে পেয়েছিলেন আনন্দ পুরস্কার। পেয়েছেন শিরোমন এবং শরৎ পুরস্কারও।

তাঁর সৃষ্ট ঋভু চরিত্রও কম খ্যাতি পায়নি। দূরের ভোর, দূরের দুপুর, নাজাই, পর্ণমোচী, পরিযায়ী, ঋভু, ঋভুর শ্রাবণ প্রভৃতি বইগুলি ছোট–বড় সকলেরই ভালবাসা কেড়ে নিয়েছিল। সেদিন এক সাংবাদিকের কাছে শুনলাম তাঁর লেখা ‘কোয়েলের কাছে’ উপন্যাস ঘিরে একটি বাস্তব–রহস্যের কথা। এই উপন্যাসটি নিয়ে নাকি সিনেমা তৈরি করার কথা অনেকেই অনেকবার ভেবেছিলেন। কেউ কেউ কাজ শুরুও করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনও সিনেমা তৈরির কাজই হয় সম্পূর্ণ হয়নি, নতুবা মুক্তির পথ দেখেনি।

যেমন পরিচালক গোষ্ঠী অগ্রগামী এই সিনেমাটি তৈরি করতে চেয়েছিল মহানায়ক উত্তম কুমারকে নায়ক করে। সিনেমাটির মহরতও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি তৈরি হয়নি। এর পর এই উপন্যাসটির কাহিনি নিয়ে হিন্দিভাষায় বোম্বেতে সিনেমা তৈরির কথা ভাবা হয়েছিল। অভিনয় করার কথা ছিল অমিতাভ বচ্চন এবং শত্রুঘ্ন সিনহার। বলা বাহুল্য, সেই প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। আরও একবার ওই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা তৈরি শুরু হয়েছিল পশ্চিমবাংলায়। অভিনয় করেছিলেন জর্জ বেকার। কিছুদিন শুটিংও হয়েছিল। তবে রহস্যজনক কারণে সেবারও সিনেমাটি শেষ করা যায়নি। বিষয়টি ভাবার মতো বইকি! অনেকে রসিকতা করে বলেন, ওই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা তৈরি হোক, তা বোধ হয় বিধাতাই চান না!

অবশ্য বাংলায় ওই উপন্যাস নিয়ে নাটক কিন্তু হয়েছে। মঞ্চে সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন জর্জ বেকারই। তবে, এ কথা ঠিক, বুদ্ধদেব গুহর লেখা কাহিনি নিয়ে খুব একটা সিনেমা তৈরি হয়নি। কিছুদিন আগে ব্রাত্য বসু একটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন তাঁর লেখা ‘বাবা হওয়া’ এবং ‘স্বামী হওয়া’ কাহিনি দুটি নিয়ে। সিনেমাটি দেখেছি। মন্দ লাগেনি।


অরণ্য এবং সাহিত্য যেমন বুদ্ধদেব গুহর রক্তে মিশে গিয়েছিল, তেমনই তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল খেলাধুলোর সঙ্গেও। তিনি ভালো ক্রিকেট খেলতেন। চুনী গোস্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। স্কুল জীব‌‌নে দু’জনে ছিলেন সহপাঠী। পড়তেন দক্ষিণ কলকাতার তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। বুদ্ধদেব ছিলেন ওই স্কুলের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। ওই দলে ছিলেন চুনী গোস্বামীও। তবে মূল দলে খেলার সুযোগ পেতেন না। একবার আন্তঃস্কুল ক্রিকেটে তাঁদের স্কুলের খেলা ছিল সাউথ সুবার্বন স্কুলের সঙ্গে। সেদিন স্কুলের কয়েকজন খেলোয়াড় অনুপস্থিত থাকায় চুনী গোস্বামীকে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব।

সেদিন চুনী গোস্বামী মাঠে নেমে ছিলেন নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে। আর নেমেই কামাল করে দিয়েছিলেন। করেছিলেন ৪৭ রান এবং নিয়েছিলেন ৪টে উইকেট। তিনি যে এত ভালো ক্রিকেট খেলতে পারেন, সেদিনই যেন সকলে জেনেছিল। জীবনটাই বদলে গিয়েছিল তাঁর। তার পর বুদ্ধদেব আর কোনও ম্যাচে তাঁকে বাদ দেননি। পরের ঘটনাগুলি তো ইতিহাস। দুর্দান্ত ক্রিকেটার হিসেবে তঁাকে চিনেছিল বাঙালি। নিজের আত্মজীবনী ‘খেলতে খেলতে’ বইতে চুনী গোস্বামী সে কথা স্পষ্ট লিখে গিয়েছেন।

শুধু ক্রিকেট নয়, ভালো ফুটবলও খেলতেন বুদ্ধদেব গুহ।‌ যে স্কুলে ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব দিতেন তিনি, সেই স্কুলেরই ফুটবল দলের নেতৃত্বে ছিলেন চুনী গোস্বামী।‌ নিজের খেলা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব একবার বলেছিলেন, ‘‘আমার খেলার পুরোটা জুড়েই ছিল চুনী। ওর জন্যই আমি ফুটবলার হতে পারিনি। ও এত ভালো খেলত যে, আমি স্কুলের ফুটবল দলে সুযোগই পেতাম না।’’ পরবর্তী সময়ে চুনী গোস্বামী যেমন খেলোয়াড় হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন, তেমনই বুদ্ধদেব গুহ সাহিত্যিক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন অসংখ্য বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে। যদিও খেলার সঙ্গে সম্পর্ক কখনও ঘুচিয়ে দেননি। কলকাতা ফুটবলে বড় ম্যাচ, মানে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের ডার্বি থাকলে, সেই ম্যাচের আগে বহুবার দুই দলের বিশ্লেষণ করেছেন। ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট নিয়েও আলোচনায় মেতে উঠতে তাঁর ক্লান্তি ছিল না। সেই কারণে অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গেই তাঁর হার্দিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

অনেক আগে মোহনবাগানের খেলার সময় প্রায়ই মাঠে যেতেন। যদিও মোহনবাগানকে সমর্থন করেন কিনা, সেই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর কখনও দেননি। প্রশ্ন করলে বলতেন, ‘‘আমার বন্ধু চুনী মোহনবাগানে খেলে। তাই ওর খেলা দেখতে আমি মাঠে আসি।’’


বুদ্ধদেব গুহর চলে যাওয়ার পর একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে। সাহিত্য জগতে অভিভাবকের মতো যাঁরা ছিলেন, সময় বিশেষে সুপরামর্শ দিতেন, না জানা অনেক কাহিনি বলে বা লিখে আমাদের সমৃদ্ধ করতেন, সেই ছাতাগুলো যেন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে মাথার উপর থেকে।

বিশেষ করে এই কোভিড–সময় আরও বেশি নিষ্ঠুর আচরণ করছে সাহিত্য–সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে। বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়াটাই যেন সহজ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। বুদ্ধদেব গুহও কোভিডে সংক্রমিত হয়েছিলেন। তখন তিনি দিল্লিতে ছিলেন। সেরেও উঠেছিলেন। কলকাতায়ও ফিরেছিলেন। রসিকতা করে বলেছিলেন, আরও অনেকদিন বাঁচবেন।কিন্তু মন সতেজ থাকলেও শরীর সায় দেয়নি। ধীরে ধীরে নানা জটিলতা দেখা দিতে থাকে তাঁর দেহে। সেটাই সমস্যা হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত। বেলভিউতে ভর্তি ছিলেন ৩১ জুলাই থেকে। আর ২৯ অগস্ট রাতে চিরদিনের মতো থেমে গেল তাঁর অনমনীয় লড়াই।

আজ ভাবতেই কেমন লাগে, ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে বৃষ্টি পড়ার কথা আর কেউ শোনাবে না!

- Advertisement -spot_img

More articles

মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে অনুগ্রহ করে আপনার নাম লিখুন

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ আপডেট