ঈশ্বরদী কলেজ।১৯৭৬।অরবিন্দ স্যার বাংলা সাহিত্যের ক্লাস এত আনন্দময় করে তুলতেন যে আমার মত গ্রেট ফাঁকিবাজও স্যারের ক্লাস মিস করতে চাইতো না।একদিন স্যার ছোট গল্পের সংজ্ঞা জানতে চাইছিলেন।ক্লাসের সবচাইতে ব্রাইট বয় শাহীন একজন মনিষীকে কোট্ করে বলে দিল-ছোট গল্প হচ্ছে বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর গভীরতা। প্রথম সারির বন্ধুরাও বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করলো।ব্যাকবেঞ্চার হলেও কেন জানি সেদিন রবীন্দ্রনাথ আওড়াতে শুরু করলাম।ছোট প্রাণ ছোট ব্যাথা,ছোট ছোট দুঃখ কথা…….।
মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে স্যার বললেন,ছোট প্রাণ ছোট ব্যাথা- সেটা কি?
মহালজ্জায় পড়লাম। মুখস্থ ছিল বলে দিয়েছি।এর ব্যাখ্যা তো জানা নাই।ক্লাসে হাসির রোল উঠলো।
স্যার একটু দম নিয়ে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন,বলতো এখন সিনেমার হার্ট থ্রব নয়িকা কে? সমস্বরে বললাম -ববিতা।
এবার স্যার বললেন,ধরো কয়েকদিন পর ঈদ।দোতলার সিঁড়ি দিয়ে হাই হিল পায়ে ববিতা টাক টাক করে নেমে বাবাকে বললো-বাবা আমার এই গাড়ীটার রং বড্ড সেকেলে।এই ঈদে আমাকে একটা লাল রঙের গাড়ি কিনে দিতে হবে।বাবা বললেন, মাই সুইট বেবী এখন হাতের অবস্থা ভালো না।পরের ঈদে কিনে দেব।
ব্যস ববিতা মনে কষ্ট পেয়ে চলে গেল।বাবাও না দিতে পারার বেদনায় কাতর হলেন।এইটা হচ্ছে বড় ব্যাথা।
আর ধরো-স্যার চশমার কাঁচ পরিস্কার করে আবারও শুরু করলেন। দরিদ্র মায়ের সন্তান তোমাদেরই এক বন্ধু ঈদের আগের দিন মাকে বললো,মা স্যান্ডেলের ফিতাটা ছিঁড়ে গেছে। কাল ঈদের মাঠে পায়ে দেয়ার মতো কিছু নেই।চার আনা পয়সা দাও ফিতাটা সারিয়ে নিয়ে আসি।কিন্তু দেয়ার মত কোন পয়সাই মায়ের কাছে নেই।কষ্টের দুফোঁটা চোখের জল ছাড়া হতভাগ্য সন্তানকে আর কিছুই দিতে পারলেন না মা।এই না দিতে পারা আর পাওয়া না পাওয়ার বেদনাটাই ছোট ব্যাথা।
আমার চোখে পানি এসে গেল। দুপাশ থেকে দুই বন্ধু ধাক্কা দিয়ে বললো,কিরে ব্যাখ্যা না পেরে কাঁদছিস নাকি।ওদের কি করে বোঝাই-স্যারের বলা এই গল্পের উপজীব্য যেন আর কেউ না।সে তো আমারই মা।শিশির বিন্দুর মতোই ক্ষুদ্র কিন্তু ভালবাসার প্রকাণ্ড সূর্যটা তার মাঝে প্রতিবিম্বিত হতো অনুক্ষণ। যা দিতে পারেননি তা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য সন্তানদের উৎসাহিত করতেন সবসময়।ছোট গল্পের মতনই মা আমার শেষ হতে দেননি কিছুই। অন্তরের অতৃপ্তিটুকু জ্বালিয়ে রেখেছেন সলতের শেষ মাথায় টিমটিম করে জ্বলা প্রদীপের মত।
আজ বিশ্ব মা দিবস।অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করলাম,অরবিন্দ স্যারের ক্লাসের মতো আজও চোখে পানি এসেছে।বৃদ্ধ মানুষের চোখের জলের গুরুত্ব থাকেনা।কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় পড়তে হবে।চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে বিষয়টা আড়াল করা গেল বটে কিন্তু আবেগের দমকে এই ক্ষুদ্র জীবনের বিশাল শূন্যতাকে গোপন করার কোন সুযোগই পেলাম না।হু হু করে উঠলো ভেতরটা।