২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর পাল্টে যায় দুনিয়ার সকল রাজনৈতিক হিসেব নিকেষ। দেশে দেশে পরিবর্তিত হতে থাকে ক্ষমতা। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে ইসলামিস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর আকাশে নেমে দুর্যোগের ঘনঘটা । তবে এখানে ইসলামের নামে কিছু কিছু উগ্রবাদ যে ছিল না তা অস্বীকার করা যায় না। ১৯৯৩ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর লিভারেল ডেমোক্রেসির নতুন যাত্রা শুরু হয় । সে যাত্রায় বাঁধ সাধে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ”। যার প্রধান যুদ্ধ ক্ষেত্র হয়ে উঠে আফগানিস্তান। কারণ টুইন টাওয়ারে হামলার পর তখন মুসলিম বিশ্বে কিভাবে ইসলামপন্থী দলগুলোকে ক্ষমতার বাইরে রাখা যায় তা নিয়ে ততপর ছিল পশ্চিমা বিশ্ব। যার ফলে দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ব্যহত হতে শুরু করে।
এরপরপরই আসে আরব বসন্তের হাওয়া। এতে তিউনিশিয়া ও মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে ইসলামপন্থী দলগুলোর উন্থানে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে পশ্চিমাবিশ্ব, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের রাজতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো। আর এতে সহায়তা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব। সরিয়ে দেয়া হয় ব্রাদাহুড সমর্থিত মোহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বাধীন সরকারকে। তুরস্কে এরদোগান সরকারকে হঠাতে ক্যু সংঘঠিত করা হয়। ইসলামি শক্তির গণতান্ত্রিক যাত্রাকে স্তিমিত করে দিতে উদ্ভব হয় আইসিস এর। সেই থেকে ইঙ্গ-মার্কিন জোটের কাছেই গুরুত্ব কমে যায় লিবারেল ডেমোক্রেসির । তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ভূ-রাজনীতি। যে ভূ-রাজনীতির বলি বাংলাদেশ। প্রথমে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের” প্রজেক্টের অংশ হিসেবে বিএনপি – জামাত জোটকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়। পরে চীনের মোকাবেলায় ভারতকে এগিয়ে দিতে আওয়ামী কর্তৃত্ববাদকেই সমর্থন করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। যার ফলে বাংলাদেশে বিনাভোটের সরকার বীরদর্পে এখন শাসনকাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে।
ফিরে আসি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের আলোচনায় । আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ২৩০০ সৈন্য হারাতে হয়েছে তাদের।আহত রয়েছেন আরো প্রায় ৫ হাজার সৈন্য। দিনের পর দিন তালেবানদেও হামলা যেভাবে আফগানিস্তানে তীব্রতর হচ্ছিল আফগানিস্তানে দীর্ঘ মেয়াদে সৈন্য মোতায়েন রাখা নানা বিচাওে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অলাভজনক প্রজেক্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল্। তাই কাল বিলম্ব না করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডুনাল্ড ট্রাম্প আফগানি বংশোদ্ভুত আমেরিকান জালমে খালিদ আজাদকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করেন আফগান সমস্যা সমাধানে। খালিদ আজাদ সক্ষম হন তালেবানদের সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে। যারই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট জু বাইডেন আগামী সেপ্টেম্বরের আগেই সেখান থেকে সকল আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষনা দেন। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ সৈন্যই দেশে ফিরেছেন। আর এতেই এশিয় প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজণৈতিক হিসেব নিকেষ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের তুমুল ঝড় বইছে দক্ষিণ এশিয়ায়।
যে ভারত কট্টর তালেবান বিরোধী তারা এখন তালেবানদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানদের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছে দেশটির কূটনৈতিকরা। যে খবর এখন ভারত প্রকাশ্যেই স্বীকার করছে। উল্লেখ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান অভিযানের সাথে সাথে ভারত, দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ব্যাপক ভিত্তিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছিল্ । ২০১২ সাল থেকে এপর্যন্ত আফগানিস্তানে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনোয়োগ করেছে ভারত।
পাকিস্তানের বিপরীতে ভারতকে সেখানে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল। এখন তালেবান ক্ষমতায় চলে আসলে তাদের মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হবার পাশাপাশি নিজের জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির মূখে পড়ার আশঙ্কা দিল্লীর । তাই দেরি না করে জম্মু কাস্মীরের নেতাদের সাথে তরিঘরি করে বৈঠকে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। নেতাদের ঢেঁকে ইনিয়ে বিনীয়ে বলবার চেষ্টা করেছেন যা হয়েছে তা ভূলে যান । নির্বাচন দিচ্ছি, শায়ত্ব শাসন দিচ্ছি। কিন্তু মোদির হিন্দুত্ববাদ কাস্মীরসহ সারা ভারত জুড়ে যে অবিশ্বাসের দেয়াল তৈরী করেছে– তা কি শুধু মৌখিক আাশ্বাসেই ভেঙ্গে যাবে? কাস্মীরের স্বাধীনতার জন্য যারা সংগ্রাম করছেন, জীবন দিয়েছেন তারা কি তালেবানদের থেকে কোনো সম্ভাব্য সুযোগ নষ্ট করতে চাইবেন? এমনি নানা হিসেব নিকেষের মাঝখানে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিন এশিয়ায় তাঁর কূটনৈতিক পদগুলোতেও দ্রুত পরিবর্তন নিয়ে এসেছে । বাংলাদেশে যোগ দিচ্ছেন নতুন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হেস্ট। অপরদিকে , যুক্তরাষ্ট্র -ভারতকে দক্ষিন এশিয়ায় কোনঠাসা করতে মরিয়া চীন। ভ্যাকসিন কূটনীতিতে চীন দাপটের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। উদ্যোগ নিচ্ছে সার্কের আদলে বিকল্প সার্ক প্রতিষ্ঠা করার। এটি সত্য আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত তালেবানরা বৈধ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেল। কিন্ত যে প্রক্রিয়ায় মার্কিন সৈন্যদের ত্বরিঘরি করে সরানো হল । তাতে আফগানিস্তানসহ দক্ষিন এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মধ্যেই পড়ল। ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানে নতুন করে যুদ্ধের দামামা বেঁজে উঠেছে। তালেবানরা দখল করে নিচ্ছে নতুন নতুন শহর। আর এই সুযোগে আলকায়দাসহ জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। সেই বাস্তবতায় “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ” আপাতত শেষ হলেও নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু হয় কিনা – তা এখন দেখার পালা।