ম্যাসেঞ্জারের সবুজ বাতি

পৃথিবীটা আচমকা থমকে দাঁড়ালো। দুর্দমনীয় গতিতে ছুটে চলা জীবনের পায়ে শিকল দিলো এক অনুজীব- করোনা। আত্মঅহমের মোড়কে বন্দি মানুষগুলো আজ অসহায়ের মতো আকাশ দেখে। উড়াল পাখির ডানা দেখে। বোটাখসা পাতার গাছের ডালে কচি পাতা গজালে তৃপ্তি পায় মনে। ফুটন্ত গোলাপের কলিতেও সুখ খুঁজে মানুষ।

শেষ কবে এতো সময় বিছানায় শুয়ে বসে কাটিয়েছি -ঠিক মনে নেই। সারাদিন এ ঘর থেকে ও ঘরে যাই, ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে আসি, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, জানালায় মুখ রাখি, আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ি। আবার উঠে ওয়াশরুম, এ ঘর থেকে ও ঘর এভাবে একই কাজ বারবার করছি। তবুও ঘড়ির কাঁটা এগোতে চায় না। মাঝেমাঝে মনে হয় ট্রেনে করে দূরে কোথাও যাচ্ছি। জীবনটাই যেন-এ্যা জার্নি বাই ট্রেন।

ফেসবুক ও ইউটিউব না থাকলে তো মনে হয় এই বন্দিশালার রাজকাহিনী আরো ভয়ংকর রকমের বিরক্তির কারণ হতে পারতো। বই পড়ি, কবিতা লেখি। নিজের ওয়ালে কবিতা পোস্ট করা,কমেন্টের রিপ্লাই দেয়া-এভাবেই কাটছে দিন। আমার দু’টো কাব্যগ্রন্থ এসেছে গত দুই বইমেলায়। সেই সুবাদে আমার কিছু ভক্তবৃন্দও আছে। তাদের কেউ কেউ ম্যাসেঞ্জারে এসে হাই হ্যালো করে। কবিতা পোস্ট করার পর তারা কবিতার পোস্টমর্টেম করে। কেউ কেউ নামের বদলে আমাকে কবি বলেই সম্বোধন করে। তখন অদ্ভুত একটা ভালো লাগা মনে কাজ করে।

মায়া- কবিতার সেই রকম সমঝদার একজন। একনিষ্ঠ কাব্যপ্রেমীও বলা যায়। গত দুই বছর ধরে ইনবক্সে শব্দ বিনিময় হচ্ছে নিয়মিত। টুকটাক কেয়ারিংও করে আমার। হঠাৎ আজই প্রথম কি মনে করে সরাসরি ভয়েস কল দিলো। কলটা রিসিভ করতেই অপরিচিত মানুষের কন্ঠে পরিচিত সেই মানুষটার স্বর খুঁজে পেলাম।’কেমন আছো,আবির?’-বলতেই শতভাগ শিওর হলাম। এই কন্ঠটা টুম্পার। যাকে আমি মায়া বলেই ডাকতাম। পনেরো বছর আগে ছেড়ে এসেছি। ধর্মের দেয়াল যাকে ছুঁতে দেয়নি।

তখন কলেজের শেষদিক। আমি টুম্পার প্রাইভেট টিউটর। প্রতিমাস শেষে টুম্পা একটা হলুদ খাম এনে দেয়। সেদিনও দিলো। খুশিতে গদগদ হয়ে পকেটে পুরে রাখলাম। হোস্টেলে এসে খুলতেই দেখি টাকার সাথে বোনাসও দিয়েছে। টুম্পার কচি হাতে ভুল বানানের একখানা প্রেমপত্র। আমিও যেন কখন তাকে নিয়ে ভাবনার সাগরে তলিয়ে গেলাম। সেই থেকে প্রতিদিন পড়ার টেবিলে আমাদের চিঠি বিনিময় হতো। আমি টুম্পাকে মায়া নামে সম্বোধন করতাম। আর মায়া আমাকে আবির নামে ডাকতো। একদিন মাসি টুম্পার পড়া টেবিলে একটা চিঠি পায়। টুম্পার বাবা নেই। মাসিই সবকিছু। একটা স্কুলে পড়িয়ে যা পান তাই দিয়ে চলে তিন জনের সংসার। মাসি আমাকে ছেলের মতো খুব আদর করতেন। রূম্পা এসে ডেকে নিলো আমাকে। মাসির জরুরি তলব। ভয়ে ভয়ে মাসির সামনে এসে দাঁড়ালাম। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে টুম্পা কাঁদছে।

-দেখ রাকিব , তোর বোন কি সব করছে! এই বয়সেই সে প্রেম ভালোবাসায় ডুবে গেছে। তাও এক মুসলমান ছেলের সাথে।

– কি বলো, মাসি! তুমি চিন্তা করো না। আমি বিষয়টা দেখছি।

– তো আর বলছি কি? দেখ্ , কি সব লিখেছে? এইসব কথা যদি মানুষ জানে- কি হবে বুঝতে পারছিস? আমি কিভাবে মুখ দেখাবো- বল। রূম্পার কি হবে? আমি নির্ঘাত মারা যাবো রে।

– মাসি, তুমি যা তা বকছো! রাখো তো। আমি সবকিছু দেখছি। তুমি চিন্তা করো না।

– হুম। তাই দেখ। তুই আমার ছেলের মতো। তাকে বুঝিয়ে বল। যদি সে এমন কিছু করে- ভগবানের দিব্যি আমি বিষ খাবো। তুই তাকে বলে দে।

তারপর আমার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। পরীক্ষার শেষ করে ঢাকায় মেসে উঠছি। ভার্সিটি ভর্তি কোচিং শুরু হয়ে গেছে। তাই বিদায় নিতে যাই মাসির কাছে। মাসি আমার মাথায় হাত রেখে বিদায় দেন। বিদায়ের পর পালাতে গিয়ে দেখি টুম্পা গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে এক সাগর জলের ঢেউ। যেকোন সময় উছলে উঠতে পারে সুনামির ঢেউ। আমার পথরোধ করে দাঁড়ায় টুম্পা।

– তুমি আমার কাছ থেকে পালাতে চাচ্ছো কেন,আবির?

– এ হয় না রে,মায়া। মাসীর মুখের দিকে তাকালে নিজেকে বিশ্বাসঘাতক মনে হয়। মনে হয় আমি পলাশীর মীরজাফর।

– তাহলে তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছো না?

– এসব চিন্তা বাদ দে। ঠিক মতো পড়াশোনা করিস। মাসির মুখ উজ্জ্বল করিস। রূম্পাকে দেখে রাখিস।

-তুমি কিছু একটা বলে যাও, প্লিজ।

– ধর্মের দেয়াল অনেক উঁচু রে। মাসি আর রূম্পার জীবন নিয়ে আমরা ছিনিমিনি খেলতে পারি না। ক্ষমা করিস আমায়। পারলে ভুলে যাস।

তারপর ভোঁ দৌঁড়। সেদিন পালিয়ে এসেছিলাম আমি। পালিয়ে বেঁচেছিলাম খুব। সেই মায়াই এতো বছর পর আজ আমার সাথে কথা বলছে। শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে চারপাশের পৃথিবী আমার একদম অপরিচিত।

– আবির, আমি জানি তুমি বেশ আছো। তোমরা সবাই যার যার মতো খুব ভালোই আছো। মা স্বর্গবাসী হলেন সেই কবে। রূম্পা বরকে নিয়ে কানাডায় সেটেল্ড। শুধু আমি ভালো নেই। একটুও ভালো নেই। সেইদিনের তোমার ফেলে যাওয়া শবদেহটা টানতে টানতে আজ আমি ভীষণ রকম ক্লান্ত। একটা সময় আমি যমদূতকে প্রার্থনায় ডাকতাম। মৃত্যুর অমোঘ বিষে নীল হতে হতে লীন হতে চাইতাম। আজ আমি যমদূতের মুখোমুখি বসে আছি। হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী এটেন্ড করতে করতে কখন যে ভাইরাসটা আমাকে গিলে নিলো-টের পাইনি। অথচ আজ না আমার ভীষণ রকম লোভ হচ্ছে। তোমাকে কাছ থেকে দেখার লোভ। তোমাকে কাছে পাওয়ার লোভ ! আমি জানি আমি ভুল সময়ে ভুল মানুষটাকে নক করেছি। আমি জানি- পাওয়ার মতো কিছুই নেই আমার।

– মায়া, এভাবে বলো না। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি তোমার পাশে আছি। আমি আসছি। তোমাকে দেয়া কথা রাখতে আসছি। সুদিনের এক সন্ধ্যায় টিএসসিতে মুখোমুখি বসে আমরা ফুচকা খাবো…

কথাটা শেষ করতে না করতেই ম্যাসেঞ্জরে মায়া নামটির পাশের সবুজ বাতিটি নিভে গেলো।

- Advertisement -

মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে অনুগ্রহ করে আপনার নাম লিখুন

Exit mobile version