বার্লিনের টিকা সম্মেলনে বক্তারা টিকাপ্রাপ্তদের মুক্তভাবে চলাফেরার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন৷ ডয়চে ভেলের লিজা হ্যানেল মনে করেন চলাফেরার স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার, বিষয়টিকে বিশেষ সুবিধা মনে করার কিছু নেই৷
সোমবারের এ সম্মেলনের আগে থেকেই টিকার দুটি ডোজ পাওয়া ব্যক্তিদের ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জোরালো হচ্ছিলো৷রবার্ট কখ ইন্সটিটিউটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত জার্মানির মোট জনসখ্যার শতকরা সাত ভাগের মতো মানুষ টিকার দুটো ডোজই পেয়েছেন৷ এই সাত ভাগের মাধ্যমে অন্য কারো সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি খুবই কম।
জার্মানির এথিক্স কাউন্সিলও মনে করে, টিকার দুটো ডোজ পেয়ে যাওয়াদের এখন মুক্তভাবে চলাফেরার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া যেতে পারে৷ তবে তাদের মতে, সেই অধিকার সবাই টিকা পাওয়ার পর ফিরিয়ে দিলেই ভালো হয়৷
অনেকে আবার এ-ও বলছেন যে, এখন কিছু মানুষকে মুক্তভাবে চলাচলের অধিকার ফিরিয়ে দেয়াটা তরুণ প্রজন্মের জন্য চপেটাঘাত হতে পারে৷ বয়স্কদের স্বার্থে তরুণদের অনেক দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে৷ এখন বয়স্করা টিকা পেয়েছেন বলে অবাধে চলাফেরা করতে পারবেন, অথচ তরুণদের বিধিনিষেধ মেনে যেতে হবে- এমন অবস্থা তরুণদের মনে অসন্তোষের জন্ম দিতেই পারে৷
করোনাকালে কোনো কষ্ট করতে হয়নি, নিয়মের বেড়াজালে জীবনকে একেবারেই বাঁধতে হয়নি- এমন একটা মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ যাদের কোনো সন্তান নেই, তারা দেখেছেন স্কুল খোলা রাখা হয়েছে, সেখান থেকে সংক্রমণও ছড়াচ্ছে৷ অন্যদিকে বাবা-মায়েরা শিশুসেবা নিশ্চিত হয়নি জেনেও চাকরিদাতাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘরে বসে কাজ করে গেছেন৷ যাদের একাকী জীবন, তারা কারো সাহচর্য পাবেন না জেনেও মেনে নিয়েছেন গৃহকোণের একাকিত্ব৷ তরুণরা আপাতত তাদের ভবিষ্যৎভাবনাকে শিকেয় তুলে রেখেছেন৷ গত একটা বছর প্রবীণদের নার্সিংহোমে নিয়মিত দেখতে যাওয়াও হয়ে ওঠেনি কারো৷
আসলে কারো জন্যই সময়টা সুন্দর ছিল না, তবে এমন সময়ের মুখোমুখি আমরা একসঙ্গেই হয়েছিলাম৷
আর এ কারণেই ‘আমরা বনাম তোমরা’, তরুণ বনাম বয়স্ক, টিকা পাওয়া বনাম না পাওয়া কিংবা পরিবার বনাম সিঙ্গেলদের আলাদা করার ভাবনাটা কেমন যেন৷ তবে আমাদের সবার লক্ষ্য তো এক আর তা হলো যত তাড়াতাড়ি যতটা সম্ভব অতিমারির আগের জীবনে ফিরে যাওয়া৷ তাই এই পথে এগোনোর প্রতিটি পদক্ষেপই আসলে সঠিক পদক্ষেপ৷
অতিমারি যেন স্বাভাবিক নিয়তি না হয়
আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোকে বিশেষ অগ্রাধিকার মনে করার সুযোগ নেই৷ এগুলো প্রাপ্য৷ বিষয়টা এমন নয় যে, জনগণকে কারণ ব্যাখ্যা করে অধিকারগুলো ফেরত চাইতে হবে, বরং যারা খর্ব করতে চান, তাদেরই তা ফিরিয়ে দিতে হবে৷ দিতে হবে, কারণ, একটা স্বাধীন দেশে সবাই যখন ইচ্ছা স্বাধীনভাবে দেশের বাইরে যেতে পারবেন এবং দেশে ফিরতেও পারবেন, এটা স্বাভাবিক৷ সবাই বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোঁরায় বসে গল্প, হাসাহাসি করতে পারবেন- এটাও স্বাভাবিক৷ কেউ রাতে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে যেতে পারবেন, প্রয়োজনে যে-কোনো কিছুর সমর্থনে বা বিরোধিতায় সমাবেশ করতে পারবেন- স্বাধীন দেশে এসবও খুব স্বাভাবিক৷ সুতরাং যদি বড় কোনো সমস্যার ঝুঁকি না থাকে, যদি নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা না থাকে, তাহলে টিকার দুটো ডোজ
বয়স্ক কোনো যুগল টিকা নিয়েছেন বলে ছুটিতে বেড়াতে যাচ্ছেন, ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরছেন, তাদের আর কোয়ারান্টিনে যেতে হচ্ছে না- এখনো টিকার প্রথম ডোজই পাননি এমন কারো পক্ষে তা সানন্দে মেনে নেয়া নিশ্চয়ই কঠিন৷ কিন্তু কোনো যুক্তিঙ্গত কারণ ছাড়া ওই যুগলকে কোয়ারান্টিনে যেতে বাধ্য করলে তো অন্য কারো লাভ হবে না৷ এমনও নয় যে, অবসরে চলে যাওয়া প্রবীণদের টিকা নেয়ার পরও বন্ধুদের সঙ্গে বসে তাস খেলতে না দিলেই দেশের সব তরুণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ এক্ষুনি পুরোদমে শুরু করে দেয়া যাবে৷
হ্যাঁ, কারো কারো কাছে কিছু মানুষকে এখন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার সুযোগ দেয়াকে অন্যায় মনে হতে পারে৷ তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাজের সবাইকে মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার স্বার্থেই এটা খুব প্রয়োজন৷ এভাবে অল্প অল্প করে সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে আর চূড়ান্ত বিচারে সেটাই তো আমরা সবাই চাই৷
ডয়েচে ভেলে।