ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) চেয়ারম্যান আরমিন লাশেটকে যারা পর্যবেক্ষণ করছেন, মাসকয়েক ধরে তার মধ্যে তারা দু’টি গুণ দেখতে পাচ্ছেন। যেগুলো চ্যান্সেলর পদের জন্য অপরিহার্য। সহনশীলতা এবং ত্যাগ। সিডিইউ চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার দৌড়ে তিনি হারিয়েছেন ফ্রিডরিশ মেয়ার্স-এর মতো তুখোড় বক্তাকে। এমনকি নরবার্ট রোয়েটগেনের মতো ঝানু রাজনীতিকও পাত্তা পাননি। এছাড়া জনসম্মুখে বেশ ক’বারের বেমানান উপস্থিতি এবং করোনা অতিমারি মোকাবিলায় নেয়া অসামাঞ্জস্যপূর্ণ কিছু উগ্যোগের কারণে ভাবমূর্তির সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলেন লাশেট। অনেকেই তাকে ‘বিমর্ষ সং’ হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন। সেই সঙ্কটকাল কাটিয়ে ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েেছিলেন লাশেট। তার ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। সিএসইউ নেতা মার্কুস যোয়েডারকে পেছনে ফেলে মনোননীত হয়েছেন ইউনিয়নের চ্যান্সেলরপ্রার্থী। অথচ যোয়েডার এমন একজন রাজনীতিক, যিনি ক্ষমতার লড়াইয়ে সবসময়ই বিজয়ী হয়েছেন।
নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার অভিজ্ঞতা
জনসংখ্যার হিসেবে জার্মানির সবচেয়ে বড় রাজ্য নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার (এনআরডব্লিউ) গভর্নর আরমিন লাশেট। কয়েক বছর ধরেই প্রশাসক হিসেবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি। জার্মানির মোট ভোটারের এক-চতুর্থাংশেরই আবাসস্থল এই রাজ্যটি। কাজেই ভোটারদের একটি বড় অংশের সমর্থন কিন্তু তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই থাকতে পারে। আরেকটি কৌতুহলদ্দীপক বিষয় হলো, নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার গভর্নরকে যেসব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, জার্মানির চ্যান্সেলরের চ্যালেঞ্জগুলো কিন্তু সেগুলোই। যেমন বড় এবং ব্যয়বহুল শহরগুলো বনাম আনুপাতিক হারে অনগ্রসর গ্রাম এলাকা; ধনী রাইনল্যান্ড বনাম দরিদ্র রুহর উপত্যকা; কর্মসংস্থানের যোগানদাতা শিল্পভিত্তিক পক্ষ বনাম শিল্পবিরোধী পরিবেশবাদী পক্ষ। এই রাজ্যটির বিশাল জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অভিবাসী। ইন্টিগ্রেশন বা একীকরণমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে লাশেটের।
লাশেট কি পারবেন সাহসী পদক্ষেপ নিতে?
তার কাজ করার ধরণ সবসময় একই রকম। সমঝোতা এবং ঐকমত্য। প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব এবং অন্যদের দূরে ঠেলা দেয়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে এড়িয়ে চলেন তিনি। যেমনটি করেছেন আঙ্গেলা মের্কেল। নেতৃত্বের চেয়ে মধ্যস্থতাই বেশি করেন তিনি।
কিন্তু জলবায়ু ইস্যুটি এতটাই বড় এবং অস্তিত্বপূর্ণ যে এর জন্য দরকার পরিষ্কার ও সহজাত কার্যপদ্ধতি। নির্বাচনী প্রচারণার সময় লাশেটের কাছ থেকে ঠিক এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর পেতে চাইবেন ভোটাররা। এটা সত্য যে, তীব্র বিতর্ক এবং কঠোর রাজনৈতিক লড়াই ছাড়া জলবায়ুসংক্রান্ত আইনগুলো পাশ করা সম্ভব হবে না। চলতি শতাব্দীর গোড়ার দিকে কল্যাণমূলক খাতগুলোর সংস্কার করতে গিয়ে এমন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন চ্যান্সেলর গারহার্ড শ্রোয়েডার। কিন্তু দৃঢ়তার সাথে তিনি সেসব সংস্কার করতে পেরেছিলেন। সমস্যা হলে এ জাতীয় সংস্কারের জন্য যে সাহস দরকার, আরমিন লাশেট তা দেখাতে পারেননি এখনো।
একমাত্র ব্যতিক্রমটি তিনি দেখিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। ওই সময়ে শরণার্থীবিষয়ক সঙ্কটে মের্কেলের নীতিকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন। অথচ তখন তিনি নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার বিরোধী দলের নেতা। কোনো কিছু হারানোর ভয় তখন তিনি পাননি।
জনসম্মুখে উপস্থিতি: লাশেটের দুর্বলতা
জনসম্মুখে উপস্থিতির বিষয়ে কাজ করতে হবে লাশেটকে। মের্কেল নিজেও নেতৃত্বের বিশেষ এই গুণটির দিকে খুব একটা নজর দেননি। করোনাসঙ্কট মোকাবিলায় এটিই ছিলো তার দুর্বলতম দিক। বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ থাকলেও মের্কেল কিন্তু জনসম্মুখে উপস্থিতির বিষয়ে কৌশলী হতে পারেননি কখোনোই। অবশ্য গেলো জানুয়ারিতে দলের সম্মেলনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় নিজের বাগ্মীতার পরিচয় দিয়েছিলেন লাশেট। তিন প্রার্থীর মধ্যে তিনিই সবচেয়ে আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছিলেন। যার মধ্যে দলের ভবিষ্যত সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণা পেয়েছিলেন দলের সদস্যরা। চ্যান্সেলর নির্বাচনের প্রচারণায় লাশেটকে নিজের ভেতর খুঁজে পাওয়া নতুন এই গুণটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
সিডিইউ/ সিএসইউ কি এখনো নেতৃত্ব দিতে সমর্থ?
আরমিন লাশেট মূলত দু’টি দলের হয়ে চ্যান্সেলর পদে লড়ছেন- সিডিইউ এবং সিএসইউ। সিএসইউ তাকে প্রার্থী হিসেবে আগেও চায়নি, এখনো চাইছে না। এমনকি সিডিইউ’র একটি বড় অংশও তার ব্যাপারে সন্দিহান। বুন্দেসতাগে সিডিইউ’র পার্লামেন্টারি গ্রুপটি প্রকৃতপক্ষে চ্যান্সেলর পদে মার্কুস যোয়েডারকে চেয়েছিলো। বাস্তবতা হলো, দু’টি দল নয় বরং একটি দলের অর্ধেকের সমর্থন আছে লাশেটের পক্ষে।
সিডিইউ আগাগোড়াই নির্বাচনী প্রচারণায় অনেকটা রোবটের মতো সক্রিয় থাকা একটি দল। ‘ক্ষমতাই দলটির চূড়ান্ত লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে সিডিইউ বরাবরই সুশৃঙ্খল। দলটি কখনোই তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহবাতিক ছিলো না। কিন্তু নির্বাচনের এই বছরটিতে সবকিছুই কেমন যেন ভিন্ন রকম। এবার বরং গ্রিন পার্টিকেই বেশি উজ্জীবিত মনে হচ্ছে। উল্টো অবস্থা সিডিইউ/ সিএসইউতে। ইউনিয়নের ভেতর যেন আগেকার সেই উদ্যম আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বায়েরবক যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একটি রাজনৈতিক লড়াইয়ের, লাশেট সেখানে অভ্যন্তরীন কোন্দলে হিমশিম খাচ্ছেন।
সময় ফুরিয়ে গেছে ইউনিয়নের!
সিডিইউ কখোনোই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনে অতিরিক্ত মাত্রায় মনোনিবেশ করেনি। দলটির সদস্যরা এক ধরনের খসড়া দিকনির্দেশনাতেই মোটামুটিভাবে সন্তুষ্ট থাকে। আঙ্গেলা মের্কেলের ১৬ বছরের শাসন পার করার পরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না এই দলটি আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে। সিডিইউ কি এখনো রক্ষণশীল একটি দল? এবং আজকের দিনে এর অর্থ কি? পরিষ্কারভাবে বললে, সিডিইউ’র অবস্থান আসলে কার পক্ষে? রাজনৈতিক ময়দানের দখল কি তারা একচেটিয়া নিতে পেরেছে? এসব প্রশ্নের জবাবের জন্য দরকার স্থিরতা এবং সময়। দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে এই দু’টি জিনিসের এখন বড়ই অভাব।
বহু দশক ধরেই সিডিইউ/ সিএসইউ’র কাছে ভোটারদের প্রত্যাশা- একটি দৃঢ় শাসনব্যবস্থা। যা কখনোই তারা দিতে পারেনি। ক্ষমতাসীন এই দল দু’টির করোনা অতিমারি-ব্যবস্থাপনা প্রথম দিকে একেবারেই অপেশাদার মনে হয়েছে। অন্যদিকে, চ্যান্সেলর পদে লাশেটের মনোনয়ন চূড়ান্ত করার সময় এক ধরনের প্রক্রিয়াগত জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে সিডিইউ’র কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ। ক্ষমতাশীন জোটের বড় দলটির শীর্ষ পর্ষদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিলো তারা বুঝি স্নায়বিক দুর্বলতায় ভোগা কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি। ঠিক একই সময়ে সাবধানতা এবং চাতুর্যের সাথে আন্নালেনা বায়েরবককে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে গ্রিন পার্টি।
ইউনিয়ন নেতাদের অস্তগামী ক্যারিয়ার
সিডিইউ এবং সিএসইউ নেতৃত্বে পর্যাপ্ত মেধার ঘাটতিও দেখছেন বিশ্লেষকরা। দল দু’টিতে বেশকিছু তরুণ গভর্নর আছেন। শ্লেসভিগ-হোলস্টাইন রাজ্যের ডানিয়েল গুয়েনঠার এবং যারল্যান্ড রাজ্যের টোবাইস হানয তাদের কাজটি ঠিকই করে যাচ্ছেন। কিন্তু ফেডারেল সরবারের চিত্রটা ভিন্ন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হোর্স্ট যেহোফারকে দেখে মনে হয়, ক্যারিয়ারের অন্তিমলগ্নে পৌঁছে গেছেন তিনি। আবার অর্থমন্ত্রী পিটার আলমায়ার কিংবা বিন্দেসতাগ সদস্য আন্ড্রেয়াস শিউইয়ারকে দেখে মনে হবে, অতিরিক্ত দায়িত্বের ভারে কাবু। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পানতো কোনো কিছুকেই গুরুত্বের সাথে নিতে চান না। আর ফ্রিডরিশ মেয়ার্স? প্রায় দুই দশক আগে সিডিইউ’র পার্লামেন্টারি দলের প্রধান হতে চেয়েছিলেন তিনি। হেরে যান আঙ্গেলা মের্কেলের কাছে। ফের বুন্দেসতাগে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ৬৫ বছরের এই বৃদ্ধকেই এবার দলের নতুন মুখ হিসেবে গণ্য করছে সিডিইউ। নরবার্ট রোয়েটগেনকে ২০১২ সালে পরিবেশমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন মের্কেল। স্বপদে ফিরে আসতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তিনি। তাতে কি? লাশেট তাকে বিশ্বাস করেন না বিন্দুপরিমাণ।
লাশেট তাহলে কার উপরে নির্ভর করতে পারবেন? একেবারেই যে নির্ভর করার মতো কেউ নেই, তা কিন্তু না। সিডিইউ’র সাধারণ সম্পাদক পাউল সিমিয়াকের উপর ভরসা রাখতে পারেন চোখ বন্ধ করে। সেই সাথে আছে নিজ রাজ্য নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ায় সিডিইউ’র শক্তি। আরেকটা বড় শক্তির জায়গা আছে লাশেটের। সেটি হলো, সবকিছুই শেষপর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে তার পক্ষে ঘটে যায়। এই অভিজ্ঞতা লাশেটকে নিশ্চয়ই উজ্জীবিত রাখবে। এসব অবশ্য চূড়ান্ত বিজয়ের ভিত্তি তৈরিতে যথেষ্ট না।
লাশেট-বায়েরবক নাকি বায়েরবক-লাশেট?
চ্যান্সেলরপ্রার্থী লাশেট কি পারবেন বায়েরবকের সঙ্গে ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে কাজ করতে?
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের একটা ছবি গোটা জার্মানিতেই আলোড়ন তুলেছিলো। যেখানে দেখা যায় আন্নালেনা বায়েরবক এবং আরমিন লাশেট একই মঞ্চে। ওই ছবিতে দু’জনকে বেশ স্বতঃষ্ফূর্ত লাগছিলো। তখনই কিন্তু সিডিইউ এবং গ্রিন পার্টির মধ্যে সম্ভাব্য একটি জোট গঠনের আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। আগামী নির্বাচনের পর ওই ছবিটি কি ফিরে আসতে পারে? চলমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের একটি সম্ভাবনা কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পদমর্যদা কি হবে? বায়েরবক-লাশেট? নাকি লাশেট-বায়েরবক?
গ্রিন পার্টির প্রার্থী আন্নালেনা বায়েরবকের সঙ্গে সরাসরি তুলনা করলে, লাশেটের ‘অভিজ্ঞতা’ সবারই চোখে পড়বে। কিন্তু ভোটাররা যদি ফেডারেল সরকারে অর্থপূর্ণ পরিবর্তন চান, সেক্ষেত্রে গ্রিন পার্টির প্রার্থীই বেশি উপযুক্ত।