একঃ জর্জ গ্যামো ( আমরা যে আল্ফা, বিটা,গামা পড়েছি সেই উনি) নামের এর রাশিয়ান বিজ্ঞানী একবার হিসাব করে দেখালেন যে ঈশ্বর পৃথিবী থেকে প্রায় ৯.৫ আলোকবর্ষ দূরে থাকেন। এক আলোকবর্ষ হল সেই পরিমাণ দূরত্ব যা আলো এক বছরে অতিক্রম করে। আমরা জানি আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে 3×108 মিটার, সুতারাং এক আলোকবর্ষ ৯ ট্রিলিয়ন কিলোমিটারের চেয়ে একটু বেশি। হিসাবটা এসেছিল এভাবে, ১৯০৪ সালে জাপান এবং রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলছিল, সে সময় রাশিয়ার কিছু চার্জে জাপানের অমংগল কামনা করে এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা কমানোর জন্য প্রার্থনা সাভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু তখন কিছু না হলেও ১৯২৩ সালে জাপানে বিশাল ভুমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় অর্থাৎ সেই অভিসাপ ফলতে প্রায় ১৯ বছর লেগে যায়। এর থেকে জর্জ গ্যামো এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে ঈশ্বর যদি আলোর বেগে তার অভিসাপ ছুড়ে মারেন পৃথিবীতে তা আসতে প্রায় ১৯ বছর লাগে সুতরাং সেই দুরত্ব হিসাব করলে এটা ৯.৫ আলোকবর্ষ দূরে হয়। এই একশ বছরে ঈশ্বর যদি আর একটু বুড়ো হয়ে যান, উনার অভিশাপ ছোড়ার গতি যদি আর একটু কমে যায়, অথবা উনি স্পিন বা গুগলি প্রাকটিস শুরু করে থাকেন, তাহলে এখন বোঝাই যাচ্ছে ফ্রান্সের অবস্থা কি হবে!!!!
দুইঃ আমি কে? কেন আমার এই পৃথিবীতে আগমন? আমার এই জীবনের উদেশ্য কি? এইরকম দার্শনিক প্রশ্ন,একটু চিন্তা ভাবনা যারা করে প্রায় সবারই এরকম চিন্তা ভাবনা মাথায় আসে। কিন্তু আসলেই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি?? আমাদের এলাকায় রাজকুমার নামে আমার চেয়ে কয়েক বছরের একজন দাদা আছে। উনি মানসিকভাবে কিছুটা প্রতিবন্ধী। উনার বাবা উনার মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য উনাকে ইন্ডিয়া গিয়ে জ্যোতিষীর কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে বিভিন্ন পাথর নিয়ে এসেছেন কিন্তু সামান্য কিছু টাকা খরচ করে সাইক্যাটিস্ট দেখাননি। এই রাজকুমার দাদাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তার জীবনের উদ্দেশ্য কি। উনি একবাক্যে বলববেন উনার জীবনের একমাত্র উদেশ্য একটা বিয়ে করা। কিন্তু উনি মানসিক ভাবে কিছুটা প্রতিবন্ধী হওয়ার কেউ উনার সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে চান না। অন্যদিকে বেশিরভাগ ধর্মের মতে, মানব জীবনের উদ্দেশ্য হল নির্বান বা মুক্তি লাভ। প্রত্যেক ধর্মে তাদের যে গ্রন্থ আছে সেই গ্রন্থ অনুযায়ী জীবনযাপন করা, সারাদিন ঈশ্বরের গুনগান করা, তার কাছে ভিক্ষা চাওয়া, তার প্রার্থনা করা তারপর তার সুনজরে পড়ে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ করাই হল মানবজাতির জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। এখন প্রশ্ন থেকে যায় স্বর্গলাভই যদি প্রধান উদ্দেশ্য হয় তাহলে তাদের পৃথিবীতে পাঠানোর দরকার কি ছিল বাপু?? আর ঈশ্বর যদি প্রশংসা পাওয়ার জন্য এইরকম ভুকাপিয়াসি হয় তাহলে ডিরেক্ট একশনে যাওয়া ভালো, কিছু উল্টোপাল্টা করেছ তো ডিরেক্ট মাইর।
তিনঃ সম্প্রতি আরনোল্ড সোয়ারজিনেগারের একটা মোটিভেশনাল ভিডিও দেখলাম সেখানে উনি বলতে চেয়েছেন প্রথমেই মানুষের উচিৎ জীবনের গোল ঠিক করা তারপর আস্তে আস্তে সেই গোল ফুলফিল করাই হল মানব জীবনের উদ্দেশ্য। তার মতে বর্তমান বিশ্বের ৭৪ ভাগ মানুষই যে কাজ করে সে কাজ তাদের পছন্দ নয়, সেজন্য তাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন মটিভেশন কাজ করে না এবং বেশিরভাগ মানুষই উদ্দেশ্য বিহীন জীবনযাপন করে। এখন জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞানীগুনি মানুষজন কি বলেছেন তা সামান্য আলোচনা করা যাক। যারা জীবনের অর্থ নিয়ে ভাবেন না, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু অনেক মানুষ আমৃত্যু জীবনের অর্থ খুঁজতে থাকেন এবং ব্যর্থতা নিয়েই পৃথিবী ত্যাগ করেন। এক্ষেত্রে ভাবুকদের সহায়তায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এসেনশিয়ালিজম নামক এই দার্শনিক মতবাদের প্রবর্তন করেন প্লেটো এবং তার শিষ্য অ্যারিস্টটল। এই তত্ত্ব বলে যে, প্রতিটি বস্তুকে নিজের অস্তিত্ব অর্থবহ করতে হলে কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য বহন করতে হয়। প্লেটোর মতে, মানুষের জীবনের অর্থ এই যে সে মানুষ। মানুষের মাঝে মানবীয় গুণাবলী তার অস্তিত্বকে সার্থক করে। সকল মানুষের মাঝেই সেসব গুণাবলী রয়েছে। যারা এসব গুণাবলীর সদ্যবহার করে, তাদের আমরা সৎ মানুষ বলি। বিপরীত দিকে রয়েছে অসৎ মানুষ। এসেনশিয়ালিজমে বিশ্বাসী মানুষ বিশ্বাস করতো তারা নিজেদের পরিচয় নিজেরা সৃষ্টি করে না, বরং সৃষ্টিকর্তা সব ঠিক করে দেন।
চারঃ এরপর সময়ের পরিক্রমায় যার মতাবাদ সবচেয়ে বিখ্যাত উনি হচ্ছেন জার্মান ফিলোসফার ফ্রেড়রিক নিটসে। উনি নিহানিজম বা ধ্বংসবাদের প্রতিষ্ঠাতা। উনি পৃথিবীতে কোনো কিছুর পেছনে কোনো যুক্তি বা কারণ আছে বলে বিশ্বাস করে না। ধ্বংসবাদের বিশ্বাস এই যে, সকল জীব ও জড়ের পেছনে আমরা যে কারণ বা উদ্দেশ্য খুঁজে পাই, সেগুলো পরম নয়, সেগুলো আমাদেরই কল্পনা মাত্র! যদিও উনি নিজেই উনার নিজের মতাবাদকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মানুষ যখন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ভাবে সুখি না হয় তখন এধরনের ধ্বংসবাদ বের হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। উনি উনার ব্যক্তিগত জীবনে কখনো সুখি ছিলেন না।
পরবর্তীতে ২০ শতকের বিখ্যাত ফরাসি লেখক, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে বিখ্যাত হয়ে আছেন তার অস্তিত্ববাদ বিষয়ক দর্শনের জন্য। দর্শনের ইতিহাসে তার ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’ বইটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর একটি। এ বইয়ের জন্য তিনি পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারও। অথচ ব্যক্তিগত দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক অভিহিত করে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি! উনি অস্তিত্ববাদের জনক। অস্তিত্ববাদ মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়। অস্তিত্ববাদের দাবি হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী এবং মানুষ কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে সৃষ্টি করেননি। একদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ায় সকল প্রকার ন্যায়, ন্যায্যতা, নিয়ম শৃঙ্খলা, আইনকানুন অর্থহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই আবার নিরন্তর অর্থ খুঁজে চলে। যেকোনো কাজের পেছনে অর্থ খুঁজে না পেলে মানুষ সে কাজ করতে দ্বিধা বোধ করে। সার্ত্রে বেঁচে থাকার এই অপরিহার্য উপাদান অর্থের খোঁজ পেয়েছেন প্রামাণিকতা থেকে। তার মতে, একজন মানুষের জীবনের অর্থ তা-ই যা সে নিজে তৈরি করে নেয়। সার্ত্রে এখানে একটি চমৎকার উদাহরণ ব্যবহার করেছেন।
ধরা যাক, একজন যুবক যুদ্ধে যেতে চায়। আবার বাড়িতে নিজের একাকী বৃদ্ধ মা কে ফেলে যেতেও তার মন সায় দেয় না। সে যদি যুদ্ধেই যায় শেষতক, তাহলে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে, যদিও তার ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ হয়ত খুব একটা প্রভাব ফেলবে না যুদ্ধের ফলাফলের উপর। কিন্তু সে যদি যুদ্ধে না গিয়ে মায়ের সেবা করে, তাহলে একজন মানুষ সর্বাত্মকভাবে উপকৃত হবেন, কিন্তু সামষ্টিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরকম সমস্যার সমাধান পৃথিবীর কেউ দিতে পারবে না সে নিজে ছাড়া। যুদ্ধে যাওয়া অথবা মায়ের সেবা করা, সে যে সিদ্ধান্তই নেবে সেটি হবে তার জন্য অর্থবহ। অন্য কথায়, ওই ব্যাক্তি নিজের জীবনের অর্থ বা উদ্দেশ্য নিজের সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই নির্ধারণ করবে।
উপসংহারঃ আসলে প্রত্যেক মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য তার নিজের এবং আলাদা আলাদা এখনে কমন কোন পারপাজ আছে বলে মনে হয় না। যেমন আমার জীবনের বর্তমান উদ্দেশ্য হিমালয় গিয়ে কয়েক বছর থাকা তারপর দেখা যাবে বাকিটা কি হয়। 😀 অবশেষে আর এক ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কামুর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি, উনার মতে
“জীবনের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আমরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে যা কিছু করি তা-ই।
চমৎকার লেখা
very informative post
অনেক কিছু জানলাম