17.7 C
Düsseldorf

মাইটি লস

Must read

একঃ বখতিয়ার খিলজি যখন উত্তর ভারতে কিছু অঞ্চল দখল করেছিলেন তখন তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি তার রাজ কবিরাজদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পেয়েছিলেন তবে তিনি আরোগ্য করতে পারেননি এবং খবু খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারপরে কেউ তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তাঁকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ুর্বেদ বিভাগের প্রধান আচার্য রাহুল শ্রীভদ্রার কাছ থেকে চিকিৎসা পরামর্শ নিতে। তবে খিলজি এ জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁর রাজ কবিরাজদের প্রতি তাঁর পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল। তিনি বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিলেন না যে,ভারতীয় চিকিৎসকরা তাঁর বা তার রাজ কবিরাজদের চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন। তবে শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে তাঁকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ুর্বেদ বিভাগের প্রধান আচার্য রাহুল শ্রীভদ্রাকে ডাকতে হয়েছিল। তখন বখতিয়ার খিলজি বৈদ্যরাজের সামনে একটি অদ্ভুত শর্ত রেখেছিলেন । সেই শর্ত হল আমি তোমার দেওয়া কোনও ধরনের ওষুধ খেতে পারব না কারন আমার ধর্মে তোমাদের জ্ঞানের প্রতি কোন আস্তা নেই, পারলে কোন ওষুধ ছাড়াই আমাকে ঠিক করে দাও। কথাটি শুনার পর অনেক চিন্তাভাবনা করে, বৈদ্য রাজ তার শর্তটি মেনে নিয়েছিল এবং কয়েক দিন পরে, তিনি একটি কুরআন নিয়ে খিলজির কাছে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন যে এই কুরআনের একটি নির্দিষ্ঠ পৃষ্ঠা নম্বর থেকে অন্যন নির্দিষ্ঠ একটি পৃষ্ঠা অবধি পড়ুন ঠিক হয়ে যাবে। বখতিয়ার খিলজি বৈদ্যরাজ এর কথা অনুসারে কুরআন পড়েছিলেন এবং তার রোগ নিরাময় হয়েছিল। কথিত আছে যে রাহুল শ্রীভদ্র কুরআনের ঐ পৃষ্ঠায় একটি ওষুধের পেস্ট প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি সেই পৃষ্ঠাগুলি যখন থুতু দিয়ে পড়েন তখন সেই থুতু দিয়া হাতের সাথে বৈদ্যরাজের লাগানো পেস্ট তার হাতের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে, যার ফলে সে তার ভেঙ্গে পড়া শরীর পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। একজন ভারতীয় পন্ডিত ও শিক্ষক তাঁর রাজ বৈদ্যদের চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন বলে খিলজি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারপরে তিনি ভারতীয় জ্ঞান এবং আয়ুর্বেদের শিকড়কে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলস্বরূপ, খিলজি নালন্দার দুর্দান্ত গ্রন্থাগারে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং প্রায় 9 মিলিয়ন পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে দেয়। কথিত আছে যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের এতবেশি বই ছিল যে এটি ৬ মাস ধরে জ্বলে ছিল। এ ছাড়াও, খিলজির নির্দেশে, হাজার হাজার পন্ডিত এবং নালন্দার সন্ন্যাসীদেরকে হত্যা করা হয়।

দুইঃ ৪১৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় গোটা এশিয়াতেই এককালে ছিল সবচেয়ে সুপরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।বিহারের রাজধানী থেকে প্রায় নব্বই কিলোমিটার দূরে নালন্দার প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। দ্বাদশ শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এই নালন্দা ছিল এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বিখ্যাত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র – সুদূর চীন, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া থেকেও ছাত্ররা এখানে পড়তে আসতেন। বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি, আর ইতালির বোলোনিয়াতে যখন ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, নালন্দার বয়স তখনই সাড়ে ছশো বছর। বর্তমান সময়ে বিখ্যাত অক্সফোর্ড এবং কেম্ব্রিজ এর প্রতিষ্ঠা সাল যথাক্রমে ১০৯৬ এবং ১২৯৫ সাল। জার্মানির গুটেনবার্গ প্রিন্টিংপ্রেস আবিষ্কার করেন ১৪৩৯ সালে এর আগে সাধারণত যতধরনের বই ছিল তার সবই হাতে লেখা। সেখানে ৯ মিলিয়ন পান্ডুলিপি আসলে যে কত সংখ্যক তা চিন্তা করলেই মাথা ঘুরে যায়। তবে ইউরোপে ইউনিভার্সিটি না থাকলেও বহুকাল আগে থেকে গ্রিসে আ্যাকাডেমিয়া, জিমনেশিয়াম এর মত প্রতিষ্ঠান ছিল সেখানে প্লেটো, এরিস্টটলের মত ব্যাক্তিরা সবধরনের শিক্ষা দিতেন। যদিও সময়ের পরিক্রমায় সব শেষ হয়ে যায় আর শিক্ষাদীক্ষার সব ভার চার্জের হাতে এসে পড়ে এবং ইউরোপে অন্ধকার যুগের শুরু হয়। সেখানে সাধারণ মানুষের শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না এবং এটা প্রায় ৮০০ বছর চলতে থাকে।

তিনঃ ৭৫০ এর দশকে আব্বাসীয় খিলাফতের সময় একটি নতুন রাজধানীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং দ্বিতীয় খলিফা মানসুর গোড়াপত্তন করেন বাগদাদ নগরীর। তবে বাগদাদের আসল সমৃদ্ধি শুরু হয় খলিফা হারুন উর রশিদের সময় থেকে। তারপর সুদীর্ঘ কাল ধরে বাগদাদের মসনদে অসীন হতে থাকেন পূর্বসুরীদের কীর্তিকেও ছাড়িয়ে যাওয়া একেক জন শাসক। তবে কালক্রমে বাগদাদের সমৃদ্ধির ইতিহাস ক্ষীয়মাণ হতে শুরু করল। দ্বাদশ শতকের শুরুরদিক থেকে হারুন উর রশিদ, মামুন, মানসুর, মুহতাসিমদের সেই পরাক্রম যেন শুধুই গল্পের মত মনে হত। বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের কেন্দ্র বাগদাদের শাসকগোষ্ঠী তখন শুধু ভোগ বিলাস ও অন্তরকোন্দলে ব্যস্ত। শেষের দিকে আব্বাসীয় খিলাফত শুধু সামরিক শক্তিতেই নয়, নৈতিকভাবেও অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। একদিকে আমীর ওমরাহ ও শাসকগোষ্টি মত্ত ছিল চরম ভোগ বিলাসে অন্যদিকে আলেম সমাজ ব্যস্ত ছিল একে অপরের উপর দোষারোপে।

অন্যদিকে মোংগল বাহিনীর প্রধান হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করার কথা ভাবছে। বাগদাদ আক্রমণের গুঞ্জন যখন কাপুরুষ খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহর কানে পৌঁছাল, ভীত সন্ত্রস্ত মুস্তাসিম তার সভাসদদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। সেই সময় মুস্তাসিমের প্রধান উজির ইবনুল আলকেমি পরামর্শ দিল সেনাবাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলার জন্য। কারণ হিসাবে সে দেখাল যেহেতু যুদ্ধ করে হালাকুকে পরাজিত করা অসম্ভব তাই অযথা এত বড় বাহিনী পুষে হালাকুর কুদৃষ্টিতে পড়ার কোন মানেই হয়না। তারচেয়ে বরং খলিফার উচিত হবে সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে হালাকুর আস্থা অর্জন করা এবং সন্ধির চেষ্টা করা। এই আলকেমি আসলে ছিল মোঙ্গল গুপ্তচর। নগরবাসী কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ একদিন ঝড়ের মত বাগদাদকে চারদিক ঘিরে ফেলল হালাকুর সৈন্যরা। আরব্য রজনীর বিখ্যাত শহর ইরাকের রাজধানী বাগদাদ ছিল ইসলামী স্বর্ণযুগের প্রাণকেন্দ্র, জ্ঞান ও বিজ্ঞান নগরী। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সুদীর্ঘ পাঁচশ বছর বাগদাদ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগর। এই অর্ধ সহস্রাব্দে সম্পদ, প্রাচুর্য কিংবা জ্ঞান-গরিমায় বাগদাদের সমকক্ষ আর একটি শহরও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কিন্তু ১২৫৮ সালের দিকে স্বপ্নের এই শহরে আচমকা নেমে এল ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। শুরু হল নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, ধ্বংস করে ফেলল বাগদাদের বিখ্যাত দারুল হিকামহ যেখানে সঞ্চিত ছিল বিগত ৫০০ বছরে মানব ইতিহাসে অর্জিত প্রায় সকল জ্ঞান। বাগদাদ একসময় প্রসিদ্ধ ছিল অনুবাদের জন্য। পূর্বে ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে পশ্চিমে গ্রীক সভ্যতা পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায় পুরনো কিংবা আধুনিক যত বই পাওয়া যেত সেগুলো গণহারে আরবিতে অনুবাদ করা হত বাগবাদে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মোঙ্গলদের আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি সেই মহামূল্যবান বইগুলোও। ধারণা করা হয় বাগদাদের দারুল হিকমা লাইব্রেরীতে পায় ১০ লক্ষ বই সংগৃহীত ছিল। পুরো কালেকশন দজলা নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল জালিম হালাকু বাহিনী। সেই অমূল্য বইগুলো টিকে থাকলে মানব সভ্যতা আজ কত বছর এগিয়ে যেত তা ভাবাও যায় না।

চারঃ তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথিবীর অন্যতম পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটা প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় এখন থেকে ২৫০০ বছর আগে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত ছাত্র ভর্তি হতো ১৬ বৎসর বয়সে, এই সময় এরা বেদ অধ্যয়ন করতো। ১৮ বৎসর বয়স থেকে ছাত্রদের শেখানো হতো শিল্পকলা, তীর নিক্ষেপ, শিকার, আইন, চিকিৎসা এবং সমরবিদ্যা। শিক্ষকদের জন্য আবসিক ব্যবস্থা ছিল। বিভিন্ন পণ্ডিতদের কাছে পর্যায়ক্রমে এ সকল শিক্ষা চলতো।

প্রায় ১০ হাজারের উপর ছাত্র-শিক্ষকের মুখরিত ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রদের কাছ থেকে শিক্ষা বাবদ এবং থাকা-খাওয়ার জন্য অর্থ গ্রহণ করতো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শিক্ষক ও বিশ্বদ্যালয়ের অন্যান্য খরচ আসতো রাজকোষ ও ছাত্রদের কাছ থেকে। দরিদ্র ছাত্ররা তক্ষশীলায় নানা রকম কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মেটাতো। বীর আলেকজান্ডার যখন ভারতে আসে তখন উনি এই বিশ্ববিদ্যালয় দেখে মুগ্ধ হন। উনি শুধুমাত্র বীরই ছিলেন না, ছিলেন এরিস্টটলের ছাত্র এবং জ্ঞানের পূজারী। এজন্য উনারাও ইচ্ছাজাগে এরকম একটা প্রতিষ্ঠান করার, এজন্য মিশরের আলেকজান্ড্রিয়ার উনি এরকম একটা প্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনা করেন কিন্তু ভারত থেকে ফেরার পথে অজানা কারনে উনি মৃত্যুবরন করেন। উনার মৃত্যুর পর উনার সম্রাজ্য চারভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মিশরের অংশ পড়ে টলেমির হাতে এবং উনি আলেকজান্ডীয়াতে একটা বিখ্যাত লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রথমদিকে লাইব্রেরিটি গ্রীক দেবী “Muse” যিনি কাব্য, সংগীত ও সাহিত্যের দেবী ছিলেন, তার মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ধীরে ধীরে তা বিদ্যালয়, গবেষণাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সে যুগের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ গবেষণা ও নিজেদের তত্ত্ব-চিন্তা প্রকাশ করবার জন্য দলে-দলে এখানে এসে জড়ো হতে শুরু করে। লাইব্রেরিটি জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং প্রায় ১০০ জন পণ্ডিত সর্বক্ষণের জন্য এখানে অবস্থান করে লেখালেখি, গবেষণা, অনুবাদ, অনুলিপি প্রভৃতি কার্য সম্পাদন করতেন। অনেকের মতে প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে পায় ৭ লক্ষের মত পান্ডুলিপি ছিল, যার মধ্যে অ্যাসিরিয়া, গ্রীস, পারস্য, মিশর, ভারতবর্ষ প্রভৃতি অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই লাইব্রেরীকে কিন্তু করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়েছিল। জুলিয়াস সিজার যখন ৪৮ খ্রিষ্টপূর্বে টলেমি (Xll) এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তখন আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণের সময় তার সৈন্যরা দূর্ঘটনাবশত লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে ফেলে। এরপরও লাইব্রেরিটির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টবাদের উত্থান হলে, ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সম্রাট থিয়োডোসিয়াস একটি অধ্যাদেশ জারি করে প্যাগান সমস্ত মতবাদকে নিষিদ্ধ করেন। যার ফলশ্রুতিতে আলেকজান্দ্রিয়ার প্যাট্রিয়ার্ক থিয়োফেলাস প্যাগান উপাসনালয়গুলো বন্ধ করে দেন। ফলে প্যাগানদের হাতে নির্মিত সেরাপিয়ামে অবস্থিত লাইব্রেরিটি ধ্বংস করে ফেলা হয়।

উপসংহারঃ উপরের এই তিনটা লাইব্রেরি ধ্বংস না হলে, আজকের এই পৃথিবী হয়ত জ্ঞান বিজ্ঞানের এতোটাই এগিয়ে যেত যে, আজ একবিংশ শতাব্দীতে বসে এখনো আমরা ধর্মের নামে যেসব মারামারি, খুনোখুনি করে বেড়াচ্ছি এটা অন্তত থাকত না।

- Advertisement -spot_img

More articles

মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে অনুগ্রহ করে আপনার নাম লিখুন

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ আপডেট