একজন রাষ্ট্রনায়কের বিদায় কতটা প্রতীকি হতে পারে! হতে পারে কতটা অনুমেয়! এমন অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা এর আগে কখনো তা দেখা হয়নি জার্মানদের। আঙ্গেলা মের্কেলের আগে জার্মানির কোনো চ্যান্সেলরই বিদায়বেলায় এমন ইতিবাচক ভাবমুর্তি ধরে রাখতে পেরেছেন কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, মের্কেল শুধু জার্মান রাজনীতিবিদই নয়, বরং বিশ্বনেতাদের সামনেই অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন।
ক্ষমতার একেবারে অন্তিম লগ্নে এসেও জরিপ বলছে, মের্কেল আছেন তেমনই, যেমনটা ছিলেন ১৬ বছর আগে। কয়েক মাস বাদেই বিদায় জানাবেন ফেডারেল চ্যান্সেলরিকে। মের্কেলের দীর্ঘ শাসন পর্যালোচনা করলে, তার দৃঢ়তা আর স্থিরতার কাছে, তার নেতৃত্বের কাছে এই বিদায় একেবারেই নগন্য। সিডিইউ এবং সিএসইউ’র নিয়মিত বৈঠকে এরইমধ্যে শেষবারের মতো অংশ নিয়ে ফেলেছেন তিনি। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সরকারপ্রধান হিসেবে শেষবারের মতো সফর করবেন যুক্তরাষ্ট্র।
এইতো গেলো ২৪ জুন দুপুরের ঘটনা। জার্মান পার্লামেন্টের রাইশটাগে, গ্লাস ডোমের নিচে শেষবারের মতো ছিলেন মের্কেল। সরকারি বেঞ্চের প্রথম সারিতে ঠিক বাম দিকে। শেষবারের মতো প্রশ্ন করলেন পার্লামেন্ট সদস্যরা। শেষবারের মতো উত্তর দিলেন আঙ্গেলা। এটাও ঠিক, জার্মানির অন্যান্য চ্যান্সেলররাও শেষবারের মতো কিছু না কিছু করেছেন। ‘শেষবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফরে’ গিয়েছিলেন গারহার্ড শ্রোয়েডার। ‘শেষবারের মতো বুন্ডেসটাগে’ গিয়েছিলেন হেলমুট কোল। কিন্তু এরআগে কোনো চ্যান্সেলরই মেয়াদ শেষ হওয়ার ক্ষণটি এতটা অনুমেয় আর এতটা প্রতীকী হয়ে ওঠেনি। কোল-এর মেয়াদ শেষ হয়েছিলো ফেডারেল নির্বাচনে হেরে গিয়ে। একই পরিণতি ছিলো শ্রোয়েডারের। ক্ষমতাসীন কোনো দলও এরআগে কখনোই পদে থাকা চ্যান্সেলরকে ছাড়া নির্বাচনী প্রচারণায় নামেনি।
আর আঙ্গেলা মের্কেল? প্রথমেই ঠিকঠাক করে নিলেন মাইক্রোফোনটা। ধীর কিন্তু স্থিরকণ্ঠে পড়তে শুরু করেন হাতে থাকা একগাঁদা কাগজ থেকে। “চলমান সংক্রমণের পরিস্থিতি অনেকটাই উৎসাহজনক এবং একটি ভালো গ্রীষ্মের আশা জাগিয়ে তুলছে।” সহজাত আর গাম্ভীর্যের সাথে মের্কেল-স্টাইলেই কথাগুলো বললেন তিনি। ধন্যবাদ দিলেন সামাজিক ‘প্রচেষ্টা’কে। সবকিছু খুলে দেয়াকে বর্ণনা করলেন ‘উপযুক্ত’ হিসেবে। একইসঙ্গে করে দিলেন সাবধান। বললেন, “অতিমারি এখনো শেষ হয়ে যায়নি।” সতর্ক থাকতে বললেন, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে।
নেই অভিযোগ, না কোনো আন্দোলন
অতি উৎসাহি কিংবা অতিরঞ্জিত কিছু করতে দেখা যায়নি মের্কেলকে। এমনকি আবেগঘন অভিযোগের আশ্রয়ও নিতে দেখা যায়নি কখনো। পেছনের সারির কিছু পার্লামেন্ট সদস্য অবশ্য শেষ মূহুর্তে এসে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন। যারা বুন্ডসটাগে আগে লড়বেন না। আফগানিস্তান ইস্যুতে ফের সরব হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তারা। চেয়েছিলেন এ নিয়ে বুন্ডেসটাগে শেষবারের মতো বক্তব্য রাখতে।
কিন্তু ভীষণ স্থির ছিলেন মের্কেল। কোনো ধরনের উত্তেজনা না দেখিয়েই, প্ল্যানারি থেকে আলাদা করেন প্রশ্নগুলোকে। প্রসঙ্গগুলো করোনা সঙ্কটের চাইতেও চমকপ্রদ হতে পারতো। কিন্তু বুন্ডেসটাগের সাধারণ মেজাজের কারণে তেমনি হতে পারলো কোথায়!
সরকারি সমীক্ষা বা জরিপ আসলে কি? এটি এমন একটি ফরম্যাট যা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি- এসপিডি বছর কয়েক আগে চালু করে। পার্লামেন্ট কোনো বিষয় জানতে চাইলে রাজ্য সচিবরা সে বিষয়ে উত্তর দেন। যাকে বলা চলে অনেকটা অনেকটা আলস্যভরা আধিকারিক ভঙ্গিতেই তাদের উত্তর আসে। কিন্তু সিডিইউ, সিএসইউ এবং এসপিডি’র সবশেষ জোটগত চুক্তি অনুযায়ী চ্যান্সেলর বছরে তিনবার বুন্ডেসটাগ সদস্যদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেখা যায় এমপিরা একে অন্যের সঙ্গে বাগযুদ্ধে জড়াতে পারেন। যে কেউ চাইলেই যে কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইতে পারেন। নির্দিষ্ট কোনো আলোচ্যসূচী সেখানে থাকে না। বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে একজন থেকে আরেকজনে।
এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো এবার আঙ্গেলা মের্কেলকেও। শেষবারের মতোই তিনি তা মোকাবিলা করেন দারুণ বিচক্ষণতায়। ফেডারেল বাজেটের প্রসঙ্গ টেনে মের্কেলকে বিব্রত করার চেষ্টায় ছিলেন এসপিডি’র কারস্টেন শ্নাইডার। কিন্তু সংখ্যাতত্ত্বিক নানা উপাত্ত তুলে ধরে মের্কেল ব্যাখ্যা করেন, ফেডারেল সরকারকে কখন আর কখন ঋণ নেয়া উচিৎ। এটা এ কারণেই যে, বিশদ বিবরণের প্রতি মের্কেলের ঝোঁকের কথা সবারই জানা। সবশেষে শ্নাইডারের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন মের্কেল। জানতে চান, “এটা কি আপনার জ্ঞানের সঙ্গে একমত পোষণ করে?” তার এই প্রশ্নে হেসে ওঠে গোটা অধিবেশন। নিজের আসনে বসে পড়তে বাধ্য হন শ্নাইডার।
প্রশ্ন করার সময় যেমন সীমিত থাকে, একইভাবে সীমিত উত্তর দেয়ার পালা। একটা সময়তো খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা হয় মের্কেলের। হলুদ ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় বিরক্তও হন খানিকটা। সঙ্গে সঙ্গেই এর ব্যাখ্যা দেন বুন্ডেসটাগ ভাইস প্রেসিডেন্ট পেট্রা পাউ। জানান, “এর অর্থ হলো আপনার কথা বলার সময় শেষ হতে চলেছে।” এমন না যে বিষয়টা মের্কেলের জানা ছিলো না। কিন্তু চ্যান্সেলর হিসেবে তার মাথায় অনেক চিন্তা-ভাবনাই ঘুরপাক খায় সর্বক্ষণ। পরে ক্ষমাও চান তিনি।
এটাও সত্য যে, চ্যান্সেলর হিসেবে ক্যারিয়ারের শেষ সময়গুলোতে খুব একটা নির্বিঘ্নে কিংবা মন খুলে কথা বলতে পারেননি মের্কেল। এজন্য অবশ্য কেউই তাকে দোষী মনে করছেন না। এমনকি এটিকেই তার চরিত্রের গুণ হিসেবে ধরে নেয়ারও কোনো অবকাশ নেই। যেমন, এফডিপি’র একজন সদস্য মের্কেলের কাছ থেকে পেনশন সংস্কার বিষয়ক প্রতিশ্রুতি আদায়ের জোর চেষ্টা করেন। খুব সহজেই তিনি উত্তর দিতে পারতেন যে, এসব এখন আর তার উ্দ্বেগের বিষয় না। তেমনটি না করে বরং স্বভাবসুলব শুষ্ককণ্ঠে জবাব দিলেন। বললেন, “বর্তমান পেনশন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই প্রমাণিত। যা অনেকেরই চিন্তার বাইরে ছিলো। এবং বর্তমান এই ব্যবস্থাটিই চলমান থাকবে।”
এখনো বলার আছে অনেক কিছু
মের্কেল হয়তো এখনো কিছু বলতে চান। কিন্তু যখন আত্ন-সমালোচনা করেন, আগেকার সেই গলার টোন খুব একটা টের পাওয়া যায় না। জলবায়ু সুরক্ষা ইস্যুতে মের্কেলের সঙ্গে বাহাসে জড়িয়ে পড়েছিলেন গ্রিন পার্টির এক নেতা। মের্কেলকে তখন নব্বইয়ের দশকের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিলো, “প্রশ্নটি যখন জলবায়ু সুরক্ষার, তখন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা অনেক ব্যয়বহুল।” মের্কেলও স্বীকার করে নেন যে ওই সময় তিনি পরিবেশষবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। জানান, জলবায়ু ইস্যুতে জার্মানি এবং গোটা বিশ্বই অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে। অবলীলায় স্বীকার করে বলেন, “কেউই দাবি করতে পারবে না যে আমরা যথেষ্ট করেছি। সময়ই নির্ধারণ করে দেবে এর সারমর্ম।”
প্রশ্নোত্তর-পর্ব তখনো চলছিলো। করোনা সঙ্কট, টিকা, বাড়িভাড়া, পেনশন- এমন নানা বিষয়ে কথা বলেন চ্যান্সেলর। প্রায় দেড় ঘণ্টায় শেষ হয় রাইশটাগে তার শেষবারের প্রশ্নোত্তর-পর্ব। নির্দিষ্ট একটি এজেন্ডার উপর একজন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটের প্রশ্নের জবাব মাত্রই দিয়েছেন মের্কেল। অধিবেশনের প্রেসিডিন্টও ওই এজেন্ডার সমাপ্তি টেনে দিয়েছেন। কিন্তু মের্কেলকে দেখে মনে হচ্ছিলো, তিনি আরো কিছু বলতে চান। কিন্তু ততক্ষণে তার মাইক্রোফোনটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চ্যান্সেলর কিছু বলছেন। কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছেন না। হঠাৎ করেই শব্দযন্ত্রে ফিরে আসে মের্কেলের কণ্ঠ। “বিধি অনুযায়ী আপনারা যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ।” রাইশটাগ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন তিনি। রাইশটাগে তার এই শেষ শব্দগুলো নিশ্চিতভাবেই কখনো বিখ্যাত উক্তি হবে না। রুটিন ধন্যবাদ দেয়াকে কেউ হয়তো মনেও রাখবে না। মের্কেলের জন্য সেটির দরকারও নেই। কারণ ১৬ বছরে উদ্ধৃত করার মতো অনেক গল্প আছে তার।
এই ১৬ বছরের সবথেকে বড় গল্পটি হলো, ‘মের্কেল হঠাও’- এমন কোনো দাবি ওঠেনি কখনো। একযুগের বেশি ক্ষমতায় থেকে জনপ্রিয় অনেক শাসকও শেষ পর্যন্ত ডুবে গেছেন স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতিতে। নিকট অতীতে কিংবা সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে এমন উদাহরণ আছে অসংখ্য। বেশিরভাগকেই বিদায় নিতে হয়েছে গণ-অভ্যত্থান কিংবা সশস্ত্র বিদ্রোহের মুখে।
কিন্তু আঙ্গেলা মের্কেল? জার্মানরা যাকে ভালোবেসে ডাকেন ‘মুটি’ যার অর্থ ‘মা’। জার্মান মূল্যবোধকে তিনি সমুন্নত রেখেছেন দৃঢ়চিত্তে। জার্মান অর্থনীতিকে তিনি দিয়েছেন শক্ত ভিত। আর প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীকে গ্রহণ করে স্থাপন করেছেন মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত। এ কারণেই ১৬ বছর পরও বিদায়বেলাতে সমান জনপ্রিয় আঙ্গেলা মের্কেল।