অপরিচিত কেউ যদি জানতে চায়, বাড়ি কোথায়, আমি বিনয়ের সাথে জবাব দেই, ঈশ্বরদী। বিসমিল্লাতেই পাবনা বলি না। কারণ অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে যে প্রথমেই পাবনা বললে প্রশ্নকর্তা চোখ বড় করে ভাবতে থাকেন ‘লোকটা পাগল নাকি?’
তার মনের ভাব বুঝে সংশয় দূর করতে যদি বলি ‘ভাই আমি পাগল নই’। তখন সে রাখঢাক না করে জোরেশোরেই বলে ওঠে,’সব পাগল ওটাই বলে।’
এর মূল কারণ পাবনায় অবস্থিত বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতাল।কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে আদতে আমরা পাগল সারাই। শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে হেমায়েত পুর ইউনিয়নে আধ্যাত্মিক সাধক শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সিংহ ভাগ জমির উপর হাসপাতালের অবস্থান। চত্বরে ঢুকেই পেয়ে যাবেন কালী দা বলে পরিচিত ব্রজ গোপাল সাহা কে। সেই ১৯৬৬ সাল থেকে আছেন। চাকরি শেষ হয়েছে ২০/২২ বছর। তবুও কি এক মায়ার টানে পড়ে আছেন। সংসারও পাতেননি। রুগীদের সেবাতেই তার দিন কেটে যায়।এদের দিকে তাকালেই নাকি কষ্টগুলি আনন্দ হয়ে ফিরে আসে। তার জবানীতেই শোনা যাক।
একনজরে পাবনা মানসিক হাসপাতাল।
তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাক্তার মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী ১৯৫৭ সালে এই হাসপাতালের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
মোট জমিঃ ১১১.২৫ একর। তন্মধ্যে ৩০ একর পাবনা মেডিকেল কলেজকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মোট ওয়ার্ড সংখ্যাঃ ১৮
শয্যা সংখ্যাঃ ৫০০ টি তন্মধ্যে পেইং বেড ১৫০ এবং নন পেয়িং ৩৫০
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে প্রতিদিন প্রায় শ’পাঁচেক রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন।চিকিৎসা প্রাপ্ত রোগীদের বহির্বিভাগ হতে বিনামূল্যে তাদের প্রয়োজনীয় সাতদিনের ঔষধ প্রদান করা হয় ।
আরও কত আনন্দ বেদনার কথা হলো কালী দা’র সাথে। তার কষ্টে বুক ভাঙে যখন দেখেন, কাউকে পাগল বলে বিনা চিকিৎসায় শেকলে বেঁধে রাখা হয় কিংবা কেউ ঢিল ছুড়ে মারে। একটু আদর ভালবাসায় চিকিৎসা করলেই এরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।
২১ জন রুগী প্রায় তিরিশ বছর যাবৎ এখানে পড়ে আছে স্বজনের প্রতীক্ষায়। কিন্তু কেউ আসেনা। তবুও অধীর আগ্রহে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি জানি কোন ফাঁকে কেউ যদি এসেই পড়ে। কালী দা একটু উদাস হয়ে এক এলো চুলের মহিলার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন,
— ঐ যে দেখছেন। নিশ্চয়ই চিনবেন।ও হলো রমা রায়।
আমি অবাক হয়ে শুধাই,’ কফি হাউজের?’
— হ্যাঁ। ওর খোঁজেই ঢাকায় এসেছিলেম মঈদুলের কাছে। তারপর থেকে এখানেই পড়ে আছি।
কাউকে চেনে না। যার জন্য এই দশা সেই আমাকেও চিনতে পারে না। শুধু কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়। গভীর রাতে ঐ পার্কটায় গোয়ানীস ডি সুজার গীটারে ঝংকার ওঠে। প্যারিস থেকে ছুটে আসে নিখিলেশ সান্যাল। অমল, সুজাতা সবাই একসাথে চুমুক দেয় কফির পেয়ালায়। ভোর হতেই সবাই মিলিয়ে যায় চার্মিনারের ধোঁয়ার মতো। আমি তখন পাগলা মেহের আলীর মতো চীৎকার করে উঠি -‘ তফাৎ যাও। সব ঝুট হ্যায়।’
কালী দা একটু ঘোরের মধ্যে চলে গেল। আমি আস্তে করে কেটে পড়ি। মাথার ভেতর ডি সুজার গীটারের সুর বাজে–
‘হরেক রকম পাগল দিয়ে মিলাইছো মেলা
বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা।’