10.2 C
Düsseldorf

বাঙালি কি সত্যিই শিল্পবিমুখ? পরিশ্রম করতে ভয় পায়?

Must read

উপমন্যু রায়
উপমন্যু রায়
পেশায় সাংবাদিক। নেশা সাহিত্য। বর্তমানে একটি দৈনিক পত্রিকা‌য় কর্মরত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম কম এবং বাংলাভাষা ও সাহিত্যে এম এ। তবে স্বপ্ন ও মননে রয়েছে কথাসাহিত্য। মানসিক দিক থেকে নিঃসঙ্গতা–প্রিয়। প্রিয় বিষয় পরাবাস্তব। প্যারাসাইকোলজি ও অ্যানসিয়েন্ট এলিয়েন নিয়ে আগ্রহ অসম্ভব। তাই পৃথিবী ও পৃথিবীর বাইরের জগৎ সম্পর্কে নিজস্ব ধারণাও রয়েছে। সেই ধারণার সঙ্গে আমাদের চোখের সামনের বাস্তবতা মিলিয়ে সৃষ্টি করেন নতুন ভাবনা, যা তঁার লেখায় দেখা যায়। এ বিষয়ে তঁার উল্লেখযোগ্য বই (‌১)‌ ‘অশরীরী আতঙ্ক/ পৃথিবীর রহস্যময় ঠিকানা’, (‌২)‌ গভীর রাতের আতঙ্ক (‌পাঁচটি অতিপ্রাকৃত উপন্যাসের সংকলন)‌, এবং (‌৩)‌ প্রেত রহস্য / মোটেও কল্পকাহিনি নয়। কল্পনা ও আবেগকে অসম্ভব গুরুত্ব দেন। তঁার কথায়, ‘‘যতদূর পারো, কল্পনা করো। কারণ, বিশ্বসংসারে অবাস্তব বলে কিছু হয় না।’’ আর আবেগ সম্পর্কে তঁার বক্তব্য, ‘‘আবেগ ফুরিয়ে গেলে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে যায়।’’ উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘‌নারী, তোমাকে’‌, ‘তার পর বৃষ্টির শব্দ’, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’, ‘তার পর অন্ধকার আরও’, ‘অন্ধকারের পিছনে’, ‘স্বপ্ন, শূন্যতা এবং’, ‘মুখোমুখি মৃত্যু তখন’, ‘তারা আসছে’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য গল্প রাতের সমুদ্র, সমুদ্র উত্তাল, সমুদ্রের দিনরাত, সমুদ্রের শূন্য শহর, সমুদ্রে অদ্রিজা, বিকেলের মৃত্যু প্রভৃতি।

বাঙালি আত্মঘাতী জাতি। বলেছিলেন নীরদ সি চৌধুরী। আর সে কথা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। অনেকে যেমন কথাটার সঙ্গে সহমত হয়েছিলেন, তেমনই বিরোধিতাও কম হয়নি। আজও কথায় কথায় অনেকের বক্তব্যেই উঠে আসে নীরদচন্দ্রের এ কথা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিতর্ক প্রসঙ্গে যেন একটু পরিবর্তন হয়েছে বাঙালির ভাবনায়। আলোচনার কোথাও গিয়ে বাঙালি যেন মেনে নিয়েছে তার আত্মঘাতী চরিত্রের কথা।

শুধু এ কথাই নয়, আরও একটি অভিযোগও শোনা যায় বাঙালি সম্পর্কে। যেমন বাঙালি নাকি অলস, পরিশ্রম করতে ভয় পায়। আজও এ কথা নানা প্রসঙ্গে অনেকেই বারবার বলে থাকেন। তবে, আমার মনে হয়, এই কথার মধ্যে যতটা না সত্য রয়েছে, তার চেয়ে বেশি থাকে অভিমান, রাগ বা ক্ষোভ। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাপনের দিকে তাকালে তা কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যায়।

কেন না, এখনও পিক আওয়ার্সে ট্রেনে–বাসে বাঙালি যে ভাবে ভিড় ঠেলে জীবন হাতে করে প্রতিদিন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করে, দিন নেই–রাত নেই, কোথাও কাজের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখলেই যে ভাবে হামলে পড়ে, তাতে আর যাই হোক, তাকে অলস বা পরিশ্রমবিমুখ বলাটা সম্ভবত ঠিক হবে না।

তবু, শিল্প–বাণিজ্য নিয়ে আজ বাঙালির আন্তরিক আগ্রহ কতখানি, তা নিয়ে সংশয় একটা থেকেই যায়। যদিও অতীতের তথ্য কিন্তু একটু অন্য রকমই ধারণাই দেয়। আধুনিক সময়ে ১৮ শতকের মধ্য ভাগ থেকেই শিক্ষিত বাঙালি কিন্তু শিল্প–ব্যবসায় যথেষ্ট আগ্রহ ও সাফল্য দেখিয়েছে। সেই সময় বহু সফল বাঙালি উদ্যোগীর নাম পাওয়া যায়। এমনকী, জামশেদজি টাটার নানা উদ্যোগে সেই সময় অনেক শিক্ষিত বাঙালির অবদান ছিল।

তথ্য বলছে, প্রথম বাঙালি কোটিপতি ছিলেন রামদুলাল দে (‌১৭৫২–১৮২৫)‌। ১৮ শতকের শেষ দুই দশক থেকে ১৯ শতকের প্রথম অর্ধ পর্যন্ত বাণিজ্য ক্ষেত্রে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত সাফল্য আজও যে কোনও সফল শিল্পপতিকে চমকে দিতে পারে। সেই তখন থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাঙালি উদ্যোগপতির সংখ্যাটা ভারতে নেহাত কম ছিল না।

সময়ের কারণেই সবার নাম বলা সম্ভব নয়। তবু মদনমোহন দত্ত, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডাক্তার নীলরতন সরকার, গোলকচন্দ্র নন্দী, মহেন্দ্রচন্দ্র নন্দী, কালিদাস শীল, হেমেন্দ্রমোহন বসু, বিপিনবিহারী দাস, প্রমথনাথ বসু, কিশোরীমোহন বাগচি, স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (‌আর এন মুখার্জি)‌ থেকে শুরু করে আরও অনেকের নাম সফল উদ্যোগপতি হিসেবে বারবার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের লেখায় উঠে এসেছে।
১৯৪৭ সালের পরও পশ্চিমবাংলায় বাঙালি শিল্পোদ্যোগীর সংখ্যা কম ছিল না। সেই সঙ্গে ভিনরাজ্যের উদ্যোগীরাও এখানকার শিল্প–বাণিজ্য ক্ষেত্রে অনেক টাকা লগ্নি করেছিলেন। যাই হোক, এই ধারাটা মোটামুটি ১৯৬০–এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বজায় ছিল। তার পরই কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি চেতনায় একটা পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে।

শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী মানেই পুঁজিবাদী। গরিব মানুষকে শোষণ করেই তাঁরা নাকি গড়ে তোলেন নিজেদের সাফল্যের ইমারত। এমনই সব ধারণা তৈরি হতে থাকে বাঙালি মননে। বড়লোক মানেই যেন একটু অন্য রকম। তাদের সাফল্যের পথটা যেন এলোমেলো। তাই তাদের দিকে একটু বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির অনেকেই।

অভিযোগটা যে পুরোপুরি ভুল ছিল, তা হয়তো বলা যাবে না, তবে বড়ই একপেশে। তবু এই ধারণাটাই আঁকড়ে ধরেছিল বাঙালি। তাই ধীরে ধীরে বাঙালি চেতনায় মজবুত জায়গা করে নেয় সমাজতান্ত্রিক চেতনা। হয়তো তাই ১৯৬০–এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭০–এর দশকের পুরোটাই পশ্চিমবাংলায় আছড়ে পড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঢেউ। এই উত্তাল সময়টাকে নকশাল যুগ বলা হয়ে থাকে।

আমি যখন খুবই ছোট ছিলাম, মানে ‌জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি পশ্চিমবাংলার রাজনীতির রং লাল। তখন থেকেই দেখতাম, কথায় কথায় রাস্তায় মিছিল হত। বহু মানুষ, যাঁরা মিছিলে হাঁটতেন, তাঁদের হাতে থাকত লাল পতাকা, মুখে থাকত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাম জ্যোতি বসু। ‘অজর অমর অক্ষয়’ ‘অব্যয়’।

এই সেদিন, মানে দশ বছর আগে অবধি বাংলার নিশান ছিল লাল। টানা ৩৪ বছর। সেই ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১। এর মধ্যে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন ২০০০ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত।
৩৪ বছরের মধ্যে ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলায় সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ছিল অপ্রতিরোধ্য।‌ পথেঘাটে, এ বাড়িতে সে বাড়িতে তখন কমরেডের ছড়াছড়ি। সেই সময় শাসক পক্ষের তরফে সাধারণ মানুষকে বৃহত্তর স্বার্থরক্ষার কথা বলা হত। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার পড়ত ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’। আর ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বঞ্চনার তত্ত্ব।

কেন্দ্রে তখন ‘আধা ফ্যাসিস্ত’ কংগ্রেস সরকার।‌ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কেন্দ্রের ‘আধা ফ্যাসিস্ত’ তত্ত্বকে সুন্দর ভাবে মিলিয়ে দেওয়া হত। রাজ্য জুড়ে বামেদের রমরমা। তাই তাঁরা যা বলতেন, তা–ই সত্য মনে হত অনেকের। তার প্রচারও চলত ব্যাপক হারে। জ্যোতি বসুর জমানার মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই কৌশলে বাজিমাত করেছিলেন বামেরা। তাই তাদের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি কেউই।

কিন্তু সমস্যা তৈরি হল তার পরই। রাজ্যের অর্থনীতির বেহাল চেহারাটা ক্রমশ যেন বাইরে চলে আসছিল। অনেক ভাবনাচিন্তা করে তা ঢাকার জন্যই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তুলনায় কেন্দ্রের বঞ্চনার ইস্যুটাকেই প্রধান্য দিয়ে আগে নিয়ে আসে বাম সরকার। আর মানুষও যে বামেদের এ–সব কথা অবিশ্বাস করেছিল, তা নয়। কারণ, ভোটবাক্সে তাদের সমর্থন কিন্তু বামেদের পক্ষেই ছিল।‌ পাশাপাশি শিল্প–কারখানায় তীব্র আকার নিয়েছিল বামপন্থী আন্দোলন। এই আন্দোলনের বেশ প্রভাবও পড়েছিল বাংলার শিল্প ক্ষেত্রগুলিতে। যেহেতু রাজ্যের ক্ষমতায় বামেরা, তাই কল–কারখানাগুলিতে তাদের শ্রমিক সংগঠনগুলির দাপট ছিল বেশি। স্বভাবতই তাদের জঙ্গি আন্দোলনে চাপে পড়ে যান মালিকরা। এক সময় ব্যবসা গুটিয়ে অন্য রাজ্যে চলে যেতে শুরু করেন তাঁরা।

শুধু অবাঙালি উদ্যোগপতিরাই নন, বাঙালি শিল্পপতিরাও ধীরে ধীরে ভিনরাজ্যে ছড়িয়ে যেতে থাকেন। অনেকটা যেন চাণক্যের নীতি মেনেই। ইতিহাসের সেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পরামর্শদাতা চাণক্য বা কৌটিল্য। সেই চাণক্য বলেছিলেন, ব্যবসায়ীদের বিশ্বের যে কোনও জায়গায় ব্যবসা করার জন্য তৈরি থাকা উচিত।

বাংলার বাঙালি এবং অবাঙালি উদ্যোগপতিদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। ফলে এই রাজ্যে শিল্প সংস্থাগুলি ক্রমে বন্ধ হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বন্ধ কারখানার সংখ্যাটা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়।
তবে এ–সব ঘটনা কিন্তু বামেদের জনপ্রিয়তায় তেমন ফাটল ধরাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তুলে রাজ্যের যাবতীয় ব্যর্থতাকে অনায়াসে আড়াল করে দিতেন বাম নেতারা। সঙ্গে কিছু কিছু জনমুখী প্রকল্প হাতে নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রিয় হয়ে যেতেন অনায়াসে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানার প্রথম দিক পর্যন্ত এই অবস্থাটা বহাল ছিল।

কিন্তু সেই বুদ্ধদেববাবুই শেষে বুঝেছিলেন, এ ভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যের সর্বনাশ হয়ে যাবে। যে ভাবে রাজ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, সেই হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না রাজ্যে। সরকারি চাকরি দিয়ে এই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, সরকারি ক্ষেত্রগুলিতেও তখন শুরু হয়ে গিয়েছে কমা, ফুলস্টপের কাজ।

সেইজন্য রাজ্যে দরকার বেশ কিছু ভারী অথবা বৃহৎ শিল্প গড়ে তোলা। তাতে রাজ্যের বহু ছেলেমেয়ে যেমন কাজ পাবে, তেমনই ওই ভারী অথবা বৃহৎ শিল্পগুলি ঘিরে আনুষঙ্গিক আরও বহু শিল্প গড়ে উঠবে। তাতেও তৈরি হবে অনেক কর্মসংস্থান। আবার তাতে মজবুত হবে রাজ্যের অর্থনীতিও।

তাই তিনি রাজ্যে শিল্পায়নের উদ্যোগ নেন। তিনি বুঝেছিলেন, রাজ্যে বড় ধরনের শিল্প তৈরি না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। ইতিহাস ক্ষমা করবে না বামেদের। স্বভাবতই শিল্পপতিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করেন তিনি।
ফলও মিলল। সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা করতে এগিয়ে এলেন রতন টাটা, শালবনিতে ইস্পাত শিল্প গড়তে রাজি হলেন জিন্দালরা, নন্দীগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ায় উদ্যোগী হল সালিম গোষ্ঠী, নয়াচরে পেট্রো–রসায়ন শিল্পতালুক গড়তে এগিয়ে এলেন প্রসূন মুখোপাধ্যায়।
এ ভাবে আরও বেশ কিছু জায়গায় শিল্প গড়া নিয়ে বিভিন্ন শিল্প গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। কিন্তু সমস্যা তৈরি হল সেখানেই। এর বিরুদ্ধেও নানা ধরনের প্রচার শুরু হয়ে গেল বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর তরফে।
যেমন, এর ফলে লাভবান হবেন শিল্পপতি–ব্যবসায়ীরা, আখের গুছিয়ে নেবেন রাজনীতির মানুষ। সাধারণ মানুষের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে যাবে। শাসক দলের কাছে সাধারণ মানুষের আর কোনও গুরুত্ব নেই।

রাজনীতিতেও তার অবধারিত প্রভাব পড়ল। হু–হু করে জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করল সিপিএম–সহ বাম দলগুলির। অনেক বাম সমর্থক বলে থাকেন, বামেদের শিল্পনীতি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ছিলেন। হয়তো তাই। তবু সেই বিতর্কে না গিয়েও এ কথা বলা যায়, তখন কিন্তু মানুষকে বোঝানো গিয়েছিল, গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে শিল্পপতিদের দিয়ে দিতে চাইছে বাম সরকার।
পাশাপাশি বামেরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জান্য ধীরে ধীরে মানুষের মনে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এইসব রাজনীতির কচকচানি থাক। তবে, এ কথা কিন্তু অপ্রিয় সত্য, পশ্চিমবাংলায় যতদিন শিল্পোদ্যোগের প্রয়াস দেখা যায়নি সরকারের কাজে, ততদিন কিন্তু মানুষের কাছে তাদের জনপ্রিয়তা অটুট ছিল।

বিপদ শুরু হয়ে গেল শিল্পায়নকে বাম সরকার গুরুত্ব দেওয়ার পর। শুধু তাই নয়, শিল্প বিরোধী আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার নেয় যে, ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটে যায় পশ্চিমবাংলায়। শুধু তাই নয়, সেই বিধানসভা নির্বাচনে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত নিজের কেন্দ্র যাদবপুরেই হেরে যান। ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এ কথা কেউই অস্বীকার করবেন না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় এনে দিয়েছিল সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের আন্দোলন। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হল, ওই দুই আন্দোলনের রং যত রাজনৈতিকই হোক না কেন, আসলে সেগুলি ছিল শিল্প–বিরোধী আন্দোলনই। ফলে শিল্পের সঙ্গে তৃণমূল সরকারের একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে যায় তখনই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মহল হয়তো সে কথা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল। তাদের সৌজন্যে মমতারও ব্যাপারটা অবোধ্য ছিল না। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, শিল্প এবং কৃষি দুই ক্ষেত্রকেই তাঁর সরকার গুরুত্ব দেবে। তাই জমি নীতিও তৈরি করেছিলেন তিনি। সে কথা ভেবেই হয়তো শিল্প মহলেরই প্রতিনিধি অমিত মিত্রকে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী করা হয়।

বাংলায় শিল্প আনতে তাই তিনি বছর বছর অনেক ঘটা করে অনেক শিল্প সম্মেলনও করেছেন। সেই সম্মেলনগুলিতে শিল্প সংস্থাগুলির তরফে হাজার হাজার কোটি টাকা লগ্নির আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। তবে সেই আশ্বাসগুলিকে আর বাস্তবে পরিণত হতে দেখা যায়নি। তাই রাজ্যে শেষ দশ বছরে বড় কোনও শিল্পও গড়ে ওঠেনি।

তবু, নির্বাচনে জিতে এই দশ বছর বাংলার ক্ষমতায় থেকে যেতে কোনও সমস্যাই হয়নি তৃণমূলের। সিপিএম বা কংগ্রেস তেমন কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াতেই পারেনি তাদের সামনে।
অবশ্য শিল্পহীন দশ বছরের প্রভাব পড়ে রাজ্যের কর্মসংস্থানে। যার স্বাভাবিক প্রভাব পড়ে আইন–শৃঙ্খলার ওপর। ফলে রাজ্যে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতারও জন্ম হয়। এর ফল দেখা যায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৪২–এ ৪২টি আসন পাওয়ার ডাক দিলেও তৃণমূল পায় মাত্র ২২টি আসন। অন্যদিকে বিজেপি পায় ১৮টি আসন, আর কংগ্রেস পায় ২টি আসন। সিপিএম কোনও আসনই পায়নি।
এর মধ্যে আরও কয়েকটি আসনে বিজেপিকে এত কম ব্যবধানে হারতে হয়, যে কারণে মনে করা হয়ে থাকে, ওই সামান্য ব্যবধান না থাকলে তৃণমূলের আসন আরও কমে যেত।

লোকসভা নির্বাচনের এই সাফল্যে বিজেপি ভেবেছিল, বাংলায় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হয়তো তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে। সেইজন্য অনেকটাই শক্তি প্রয়োগ করেছিল বাংলার প্রচারে। তাই মনে করা হয়েছিল, এই নির্বাচনে বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। বাস্তবিকই প্রচার অভিযানে এবার তৃণমূলকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। ব্যাপারটা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন মমতা। তাই তিনি দলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করেন প্রশান্ত কিশোরকে। প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর সংস্থা গোটা রাজ্যে সমীক্ষা চালিয়ে বাঙালির প্রকৃত ভাবনাটা বুঝে যান। বুঝে যান, এই মুহূর্তে সাধারণ বাঙালি কী চাইছে?

তাঁরই পরামর্শে লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পর পর জনমুখী প্রকল্প গ্রহণ করতে শুরু করে, যা সাধারণ মানুষের ওপর বেশ প্রভাব ফেলে। যার সুফল মেলে ভোটবাক্সে। সবাইকে চমকে দিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরে আসে ২১৩টি আসন পেয়ে।

অন্যদিকে, আগের বিধানসভা নির্বাচনে পাওয়া ৩টি আসন থেকে অনেক শক্তি বাড়িয়ে এবার ৭৭টি আসনে পৌঁছে গেলেও বিজেপি ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। আর, সিপিএম বা কংগ্রেস তো মুছেই যায় ফলাফলের বোর্ড থেকে।
এ কথা আজ স্বীকার করতেই হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতই বলুন না কেন, ২৯২টি আসনে তিনিই প্রার্থী, তাঁর জনপ্রিয়তার জোরে কিন্তু এই নির্বাচনে তৃণমূল জেতেনি। যদি তাই হত, নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে স্বয়ং তিনিই হেরে যেতেন না। তবে তিনিই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।

নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে ছ’মাসের মধ্যে কোনও আসনে উপনির্বাচনে জিতে আসতে হবে। ইতিহাস বলছে, উপনির্বাচনে শাসক দলেরই প্রভাব বা আধিপত্য থাকে। কেন না, সেই নির্বাচন পরিচালিত হয়ে থাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়। তাই মমতা যে সহজেই উপনির্বাচনে জিতে আসবেন, তা অনুমেয়।

এই নির্বাচনে মমতার তৃণমূলকে বাংলা থেকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়নি। আর তা করতে পারেনি বিজেপি। কারণ কী? অনেকেই বলবেন, বিজেপি ধর্মের কথা বলে! বাঙালি তা গ্রহণ করেনি। কিন্তু, সত্যি বলতে কী, এ সব ছেঁদো কথা। রকের আড্ডায় কাজে লাগতে পারে। তাতে সত্য নেই।

কারণ, বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কখনও হিন্দু–মুসলিম তত্ত্বের কথা বলেননি। বরং মমতাই মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সংখ্যালঘু মানুষকে বলছি, আপনারা কেউ বিজেপিকে ভোট দেবেন না।’ আর এ কথা বলার জন্য নির্বাচন কমিশন তাঁকে শো–কজও করেছিল।

আসলে ধর্ম দিয়ে কখনও ভোটে জেতা যায় না। তা হলে অনেক আগেই পশ্চিমবাংলার ক্ষমতায় বিজেপি চলে আসত। কারণ, পশ্চিমবাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই হিন্দু বাঙালি।
বরং প্রচারে নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহরা বারবার রাজ্যের বেহাল অর্থনীতির কথা টেনে এনেছেন, দুর্নীতির কথা বলেছেন, বলেছেন বিনিয়োগে খরার কথাও।

তা হলে এই নির্বাচনে তৃণমূল জিতল কীসের জোরে? একটাই উত্তর, ওই জনমুখী প্রকল্প। অন্যদিকে, কংগ্রেসই বলুন, বা বিজেপি, জাতীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে তারা যতই সাপে–নেউলে হোক না কেন, তারা আসলে একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
সর্বভারতীয় স্তরে দুটি দলের সঙ্গেই শিল্পপতিদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। স্বভাবতই তারা যে সব রাজ্যে ক্ষমতায় যায়, সেখানে শিল্পপতিদের আনাগোনা বাড়ে। সেই পথে উদ্যোগও বাড়ে। লগ্নি হয়। তাই শিল্প হয়। বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
পশ্চিমবাংলায় অতীতে তা–ই হয়েছে। শিল্প ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলার যে–টুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা হয়েছে বিধানচন্দ্র রায়ের হাত ধরেই। তার মানে কংগ্রেস জমানায়।

তা কলকাতা বন্দর, লবনহ্রদ বা কল্যাণী উপনগরী, লেকটাউন, দুর্গাপুর এবং আসানসোল শিল্পাঞ্চল, উতর–পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে কলকাতার বিমান যোগাযোগ, সবই হয়েছে বিধান রায়ের উদ্যোগে। দুর্গাপুর ইস্পাত নগরী, চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা, হরিণঘাটা দুধ প্রকল্প তো আজ ইতিহাস। শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি করেছিলেন কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থাও।

উন্নয়নের নিরিখে গোটা ভারতে পশ্চিমবাংলাকে বিধান রায় নিয়ে এসেছিলেন একেবারে প্রথম সারিতে। তিনি বুঝেছিলেন, শিল্প ক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারলে রাজ্যের উত্তর–প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে। তাই ভারী থেকে বৃহৎ শিল্পের মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের গলায়।

সেই কারণে বিধানচন্দ্র রায়কে ‘বাংলার রূপকার’ বলা হয়ে থাকে। সেই সুফল আজও ভোগ করে চলেছে রাজ্যের মানুষ। শুধু ভোগই নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য শিল্পগুলির অর্মাযাদাও কম করেনি।
অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের জেরে পশ্চিমবাংলার সিঙ্গুর থেকে টাটার গাড়ি কারখানা সরে সোজা চলে গেল নরেন্দ্র মোদির গুজরাটের সানন্দে।
তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কংগ্রেস বা বিজেপির অর্থনীতির মধ্যে এই মুহূর্তে খুব বেশি তফাত নেই। শুধু সরকারে থাকা অথবা বিরোধী পক্ষে, সেই অনুযায়ী বিজেপি বা কংগ্রেস একে অপরের দিকে তোপ দাগে মাত্র।

এখন কথা হল, এই নির্বাচন থেকে আমরা কী দেখতে পেলাম? শিল্পায়ন নির্ভর বিজেপিকে মানুষ গ্রহণ করেনি, কিন্তু জনমুখী প্রকল্পের জন্য তৃণমূলকেই শেষ পর্যন্ত পছন্দ করেছে। স্বভাবতই প্রশ্নটা উঠছে, বাঙালি কি তবে সত্যিই শিল্প–বিরোধী? পরিশ্রম করতে ভয় পায়? না হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী প্রকল্পগুলিকে এ ভাবে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবে কেন? অপ্রিয় সত্য হল, এই জনমুখী প্রকল্পগুলিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতই ‘উন্নয়ন’ বলে অভিহিত করুন না কেন, এই পদ্ধতি কখনও উন্নয়ন হতে পারে না! কারণ, এই পদ্ধতি মানুষের দীর্ঘকালীন সমস্যা মেটাতে পারে না। তবে কি জনমুখী প্রকল্পের কোনও গুরুত্ব নেই? আছে। তবে তা তাৎক্ষণিক। এই মুহূর্তে মানুষের যা প্রয়োজন, তা হয়তো জনমুখী প্রকল্প থেকে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘকালীন সময়ে একটা রাজ্যের অর্থনীতির কোনও উন্নতি ঘটাতে পারে না এই ধরনের প্রকল্প। তাই মানুষেরও দীর্ঘকালীন কোনও লাভ হয় না।

রাজ্য ও রাজ্যের মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে প্রয়োজন শিল্প এবং ব্যবসা–বাণিজ্যের ধারাবাহিক উন্নতি। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর তার নিশ্চিত প্রভাব পড়বে। লক্ষণীয়, প্রতি বছরই পশ্চিমবাংলা থেকে অসংখ্য মানুষ কাজের সন্ধানে ভারতেরই অন্য রাজ্যগুলিতে চলে যান। কেন যান তাঁরা?

উত্তর হল, হয় তাঁরা এখানে মনের মতো কাজ পান না, অথবা পেলেও আশানুরূপ বেতন পান না। তাই তাঁরা পশ্চিমবাংলা থেকে বিনাদ্বিধায় বাইরের দিকে পা বাড়িয়ে দেন।

তবে সেই বাঙালিই কিন্তু রাজ্যের নির্বাচনে জনমুখী তৃণমূলকে পছন্দ করে, শিল্প–ঘেঁষা বিজেপিকে নয়। ভাবতে হচ্ছে বইকি। সিপিএম যতদিন শিল্প–বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেয়নি, ততদিন বহাল তবিয়তে বাংলার ক্ষমতায় থেকে গিয়েছে। যখন শিল্পায়নের কথা ভেবেছে, তখনই বাঙালি তাদের নির্মম ভাবে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বিজেপির শিল্পভাবনাকেও এবার প্রশ্রয় দেয়নি তারা। বরং তৃণমূলের জনমুখী উদ্যোগকেই গ্রহণ করেছে। তা হলে বাঙালি কি এখন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না? নাকি সে–ভাবে ভাবার ক্ষমতাটাই সে হারিয়ে ফেলেছে?

যদি হয়, তা হলে বাস্তবিকই কি সে শিল্পবিমুখ? কিন্তু চিরকাল তো সে তেমন ছিল না! না হলে বিধানচন্দ্র রায়ের সময়ে এত শিল্পায়ন হয় কী করে? বাঙালি তো তখন বিধান রায় বলতে পাগল ছিল! তখন শিল্প–বাণিজ্য, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই বাঙালির সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়।

—মানে? বাঙালির বর্তমান কি তবে আজ এতটাই সঙ্কটে পৌঁছে গিয়েছে যে, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার ক্ষমতাটাই আজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে! ভয় হয় ভাবতে।

- Advertisement -spot_img

More articles

মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে অনুগ্রহ করে আপনার নাম লিখুন

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ আপডেট