17.7 C
Düsseldorf

বাংলা ভাষার অলঙ্কারের গল্প

Must read

অলঙ্কার একটা মানুষকে যেমন আরো সুন্দর করে সাজিয়ে তোলে, তেমনি বাগধারা এবং প্রবাদ বাক্য হল বাংলা ভাষায় অলংকার যেটা বাংলা ভাষাকেও আরো সুন্দর করে উপস্থাপন করতে সাহায্য করে। কিন্তু আমরা কখনো কী ভেবে দেখেছি, এই যে মজার মজার বাগধারা আর প্রবাদ প্রবচনগুলো আমরা পড়ছি, কথা বলতে ব্যবহার করছি, এদের পেছনে একটা গল্প থাকতে পারে? হ্যাঁ, আমাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত এসব বাগধারার প্রায় প্রতিটির পেছনেই একটা গল্প আছে। কখনো সে গল্পটা মজার, কখনো সে গল্পটা একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার। আজকে তার কয়েকটি উল্লেখ করার চেস্টা করা হল।

মগের মুল্লুকঃ মোগল আমলের কথা,তখন আমাদের এই দেশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য জাতি এবং দস্যুদের চোখ পড়ল এদেশের ওপর। সেসময় আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরাকান (বর্তমান রোহিঙ্গা অঞ্চল) থেকে আগত মগ জলদস্যুরা অনেক লুটপাট আর অরাজকতা চালায়। সেই থেকে মগের মুল্লুক কথাটা প্রচলিত হয়।

খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশেঃ ১৭৪১ সালের দিকে মারাঠারা ( বর্তমান মুম্বাই যেখানে, বাজিরাও মাস্তানি এবং মূনির চৌধুরীর রক্তত প্রান্তর এই এলাকার কাহিনি) বাংলা আক্রমণ করে। বাংলায় এসে এরা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়, লুটপাট করে, খুন করে। তাদের অত্যাচারে বাংলার মানুষ খুবই দুঃখ দুর্দশায় কবলিত হয়। তখন থেকে বাচ্চাদের মারাঠা বর্গিদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হত, সেই থেকে এটা প্রচলিত।

হরি ঘোষের গোয়ালঃ কলকাতা শহরের শোভাবাজার এলাকায় হরি ঘোষ নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি বাস করতেন। তার ছিল বিশাল এক অতিথিশালা যেখানে তিনি সবাইকে আশ্রয় দিতেন। ফলে ক্রমেই সেটা অলস আর কুঁড়ে লোকের আস্তানায় পরিণত হয়। সে থেকেও “হরি ঘোষের গোয়াল” বাগধারাটি প্রচলিত হয়।

লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেনঃ হুগলির বাসিন্দা গৌরী সেন সপ্তদশ শতকের লোক। কথিত আছে, ব্যবসাসূত্রে তিনি দস্তার পরিবর্তে এক জাহাজ রূপো পেয়েছিলেন। পারিবারিক আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় তিনি বিপুল ধনসম্পদ অর্জন করেন। সেই লাভের টাকা তিনি সৎকর্মে ব্যয় করবেন বলে সংকল্প করেন। দুহাতে অসহায়দের মাঝে দান করতে থাকেন। সবার প্রয়োজনে মুক্তহস্তে দান করে তিনি প্রবাদে স্থান করে নিয়েছেন। আর এভাবেই লোকমুখে চলে এসেছে, “লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন”

যত দোষ নন্দ ঘোষঃ শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পর তার পালক পিতা নন্দ ঘোষ কর্তৃক তাকে আশ্রয় দান ও লালনপালনের কাজকে দোষ হিসেবে আখ্যায়িত করে এ বাগবিধিটির উৎপত্তি হয়েছে। নন্দ ঘোষ মথুরার বিপরীতে গোকুল গ্রামে বাস করতেন। শ্রীকৃষ্ণের মামা কংস সে সময়ে মথুরার রাজা ছিলেন। কংস তার বোন দেবকীকে বসুদেবের সাথে বিয়ে দেন। কংস এ সময় দৈববাণী থেকে জানতে পারেন যে, এ বোনের গর্ভজাত কোন সন্তানের হাতে তার মৃত্যু হবে। সুতরাং তিনি বসুদেব ও দেবকীকে কারারুদ্ধ করে রাখেন। কারাগারে বসুদেব দম্পতির সাতটি সন্তানের জন্ম হয় যাদের ছয় জনকে কংস হত্যা করেন। সপ্তম সন্তান বলরামকে কৌশলে বাঁচিয়ে নন্দ ঘোষের কাছে লালনপালনের ভার দেওয়া হয়। একই রাতে নন্দ ঘোষের স্ত্রী যশোদার গর্ভে মহামায়া নামে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। বসুদেব সন্তানকে রক্ষার জন্য তাকে নিয়ে ঝড়-বৃষ্টিময় ঐ রাতে কারাগার থেকে বেরিয়ে নন্দ ঘোষের বাড়িতে যান। শ্রীকৃষ্ণকে যশোদার কোলে স্থাপন করে তার কন্যা সন্তানকে নিয়ে কারাগারে ফিরে আসেন। নন্দ ঘোষের গৃহে লালিত হতে থাকেন শ্রীকৃষ্ণ। কংস জেনে যান সে কথা। কৃষ্ণকে হত্যার জন্য গোকুলে অনেক গুপ্তচর পাঠান তিনি। নন্দ ঘোষ কৃষ্ণকে রক্ষার জন্য বৃন্দাবনে নিয়ে যান। কংস কৌশলে ধনু যজ্ঞের অনুষ্ঠান উপলক্ষে কৃষ্ণকে সেখান থেকে মথুরায় আনার ব্যবস্থা করেন। মল্লযোদ্ধাদের লাগিয়ে দেন কৃষ্ণের পিছনে। কংসের এ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। বরং তিনিই নিহত হন কৃষ্ণের হাতে। নন্দ ঘোষের কারণে কংসের সকল যড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এজন্য সমস্ত দোষ নন্দ ঘোষের।

সাক্ষী গোপালঃ এই বাগধারাটি এসেছে প্রাচীন লোকগাঁথা থেকে। অনেক অনেক কাল আগে, পুরীতে তীর্থ করতে যেয়ে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেসময় এক তরুণ তার সেবা করে তাকে সুস্থ করে তোলে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ব্রাহ্মণ নিজের মেয়ের সাথে ওই তরুণের বিয়ে দিতে চাইলেন।
তীর্থ শেষে ব্রাহ্মণ নিজের দেশে ফিরে গেলেন। আর ভুলেও গেলেন তরুণের কথা। এদিকে তরুণ দেশেবিদেশে ঘুরে অবশেষে ব্রাহ্মণের সন্ধান পেল। ব্রাহ্মণকে যেয়ে তার প্রতিজ্ঞার কথা বলতেই ব্রাহ্মণ বেঁকে বসলেন। ব্রাহ্মণ দাবী জানালেন প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হাজির করার। তরুণ গেল শ্রীকৃষ্ণের কাছে। তাকে অনুনয় জানাল সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। তরুণের অনুনয় বিনয় শুনে তিনি রাজী হলেন সাক্ষ্য দিতে। তবে একটা শর্ত বেঁধে দিলেন। কী সেই শর্ত? তিনি সাক্ষ্য দিতে তরুণের পেছন পেছন ব্রাহ্মণের গ্রামে যাবেন। তবে যাত্রাপথে তরুণ পেছন ফিরে তাকালেই তিনি থেমে যাবেন। আর সাক্ষ্য দিতে যাবেন না। ভয়ে ভয়ে তরুণ যাত্রা করল। যাত্রাপথে কৃষ্ণের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপল। তিনি পায়ের শব্দ লুকিয়ে ফেললেন। এতে তরুণ ভয় পেয়ে গেল। পেছন ফিরে তাকাল। আর কৃষ্ণ সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। সেই থেকে যারা কোনো সমস্যা দেখেও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে, তাদের বলা হয় “সাক্ষী গোপাল”।

ঠনঠন গোপালঃ গোপাল ভাঁড় প্রায় আঠারোশ শতাব্দীর দিকে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় একজন রশিক ছিলেন। তিনি মজার মজার গল্প ও কাজের মাধ্যমে সবাইকে মজা দিতেন কিন্তু নিজের ধনসম্পদ তেমন কিছু ছিল না। এই থেকে ঠনঠন গোপাল কথাটি প্রচলিত হয়েছে, যার শুধুমাত্র কথাই আছে কিন্তু কাজের বেলায় ফাকা।

- Advertisement -spot_img

More articles

মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে অনুগ্রহ করে আপনার নাম লিখুন

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ আপডেট