ইন্দো-প্যাসিফিক সামুদ্রিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে সামরিক মহড়া করছে সামরিক জোট ‘কোয়াড’-এর অন্তর্ভুক্ত ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে এতে নেতৃত্ব দেবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ফ্রান্স। লা পেরোজ নামের মহড়াটিতে এবারই প্রথম যোগ দিয়েছে ভারত। এর আগে ২০১৯ সালে ভারতকে ছাড়াই এই নামে মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ খবর দিয়েছে দ্য নিক্কেই এশিয়া। আর এই ঘটনায় দৃশ্যতই চিন্তিত মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। দেশটি একইদিন নিজেরাও সামরিক মহড়া চালানোর ঘোষণা দেয়। খবরে বলা হয়, ফ্রান্সের নেতৃত্বে তিন দিনব্যাপী মহড়াটি শুরু হয়েছে সোমবার থেকে।
নয়া দিল্লির ফরাসি দূতাবাস গত বুধবার এক বিবৃতিতে জানায়, এই মহড়া পাঁচটি সমমনা, উচ্চ পর্যায়ের নৌ শক্তির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির এবং অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামুদ্রিক সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি সুযোগ।
গত ১২ই মার্চ অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত ফোরাম ‘দ্য কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ (কোয়াড)-এর প্রথম যৌথ সম্মেলনের পরই এই মহড়ার ঘোষণা আসে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের এশিয়া সফরের সময় সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। মহড়াটিকে এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, এর আগে গত নভেম্বরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মালাবার সামরিক অনুশীলন করে চার কোয়াড সদস্য। তাদের সঙ্গে ফ্রান্স যুক্ত হওয়ায় দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা নতুন উচ্চতা পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা ও কৌশল বিষয়ক বিশ্লেষক এবং সংবাদমাধ্যম ডিফেন্সের সম্পাদক এন সি বিপিন্দ্র বলেন, কোয়াড দেশগুলোর এই যৌথ মহড়া এই অঞ্চলের উপর নজর রাখা প্রত্যেকের কাছেই তাৎপর্যপূর্ণ। অবশ্যই চীনও সেসব পর্যবেক্ষকদের মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আগ্রাসী সামরিক তৎপরতার মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধি করেছে দেশটি। ঘরের কাছে কী হচ্ছে, তা নজরে রাখবে তারা।
এদিকে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের অবৈধ দাবি ঘিরে কোয়াড দেশগুলো এবং ফ্রান্স বিভিন্ন ফোরামে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবাধ চলাচলের বিষয়ে আলোচনা করে থাকে।
বিপিন্দ্র বলেন, লা পেরোজ মহড়াটিকে সংকটময় পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলে সামরিক আন্তঃব্যবহার্যতার জন্য ওই পাঁচ দেশের নৌ পরিচালনার চর্চা হিসেবে দেখাটাই স্বাভাবিক। এই পদক্ষেপ এ অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক ডাইনামিক্স কী রূপ নেবে তার একটি নির্দেশক। এছাড়া, কোয়াড দেশগুলোর এ অঞ্চলে স্বার্থ রয়েছে এমন গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে হাত মেলানোর প্রক্রিয়ারও শুরু। ইতিমধ্যে কোয়াড একটি এশীয় ন্যাটো হিসেবে গড়ে উঠার কথাও শোনা যাচ্ছে।
ফ্রেঞ্চ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস এর সহকারী গবেষক ইজাবেল সেইন্ট-মেজার্ড বলেন, এই মহড়া থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ফ্রান্স সমমনা ও পরিবর্তনশীল জোট গঠনে ইচ্ছুক। তারা সামুদ্রিক আইন, চলাচলের স্বাধীনতা, সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং সবমিলিয়ে আইন-ভিত্তিক বহুপক্ষীয় শৃঙ্খলা স্থাপন করতে চায়।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ দপ্তরের সাবেক পরিচালক এবং ও পি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির প্রতিরক্ষা ও কৌশল বিষয় অধ্যাপক পঙ্কজ ঝা বলেন, এই মহড়ার বড় লক্ষ্য হচ্ছে দুটি বিষয়ে সম্পর্ক স্থাপন: ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় জোট এবং ভারত সাগরে কোয়াড দেশগুলো ও ফ্রান্সের জোট।
তিনি বলেন, ফ্রান্স জানে যে চীন এ অঞ্চলের সমুদ্রগুলোয় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ আহরণ, বিশেষ করে ভারত সাগরের ফরাসি অংশে। ফ্রান্স এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একক ও যৌথ পদক্ষেপ নিতে চায়।
বেইজিং-ভিত্তিক সামরিক বিষয়ক বিশ্লেষক উয়েই দংশু গত মাসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত এক মতামত কলামে পাঁচ দেশের সামরিক মহড়াটিকে একটি ‘প্রচারণা কৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া, কোয়াডকে এর সদস্য দেশগুলোর সাময়িক স্বার্থ অর্জনে গঠিত সংগঠন আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
উয়েই আরো লিখেছেন, কোয়াডের সামরিক পদক্ষেপগুলো নিশ্চিতভাবেই চীনকে লক্ষ্য করে নেয়া। তিনি লিখেছেন, চীনের এখন যেটা করা উচিৎ তা হচ্ছে, নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং সামুদ্রিক অঞ্চলে লড়াইয়ের শক্তি বাড়ানো। একইসঙ্গে বিশ্বের কাছে এটাও প্রমাণ করতে হবে যে, শক্তিশালী চীনা নৌ-বাহিনী বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করবে।