ফ্রেডি ফিগারসকে প্রথম কম্পিউটার দেয়া হয়েছিল তার দশ বছর বয়সে। কম্পিউটারটা ছিল পুরনো এবং ঠিকঠাক কাজও করছিলো না, কিন্তু প্রযুক্তি জগতের সাথে ফ্রেডির ভালোবাসার সম্পর্কের শুরুটা সেখান থেকেই। পরবর্তীতে এই ফ্রেডি ফিগারসই হয়ে ওঠেন একজন আবিষ্কারক, উদ্যোক্তা এবং টেলিকম মিলিয়নিয়ার।
অথচ ফ্রেডির জন্মের সময় খুব কম মানুষই তার এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যত প্রত্যাশা করেছিল। আট বছর বয়সে বাবা নাথানকে ফ্রেডি জিজ্ঞাসা করেছিলেন তার জন্ম সম্পর্কে। তখন যে উত্তর পেয়েছিলেন, তা কোনোদিনও ভুলবার মত ছিলনা। নাথান জবাব দিয়েছিলেন, ‘দেখো ফ্রেড, আমি তোমাকে সরাসরিই বলতে চাই। তোমার জন্মদাত্রী মা তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। আমি এবং বেটি মে তোমাকে দত্তক নিয়েছি এবং তুমি আমারই ছেলে।’
বাবা নাথান ও মা বেটির সাথে ফ্রেডি ফিগারসকে পাওয়া গিয়েছিল ফ্লোরিডার একটি গ্রাম্য এলাকায় ডাম্পস্টারের (ময়লা ফেলার বড় কন্টেইনার) পাশে। বাবার কথা শুনে ফ্রেডির মনে হয়েছিল ‘আচ্ছা, আমি তাহলে আবর্জনা।’ কিন্তু বাবা তাকে বলেন, ‘তুমি কখনো এই বিষয় নিয়ে কষ্ট পাবে না।’ ফ্রেডির পালক বাবা নাথান ফিগারস ছিলেন একজন রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী ও বাড়িঘর মেরামতকারী এবং পালক মা বেটি মে কৃষি কাজ করতেন। ১৯৮৯ সালে ফ্রেডি যখন জন্ম নেন, তখন তাদের বয়স ছিল পঞ্চাশের কাছাকাছি। তারা ফ্লোরিডার কুইন্সি অঞ্চলে বাস করতেন।
নিজেদের সন্তান থাকা সত্ত্বেও, ফ্রেডির মাত্র দু’দিন বয়সেই তারা তাকে দত্তক নেন। ফ্রেডি জানালেন, তারা তাকে নিজ সন্তানের মত ভালোবাসলেও কুইন্সি অঞ্চলের অন্যান্য শিশুরা তার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেছে।
‘তারা আমাকে ডাম্পস্টার বেবি, আবর্জনা থেকে পাওয়া ছেলে, তোমাকে কেউ চায় না ইত্যাদি কথা বলতো। মাঝেমাঝে তারা আমাকে স্কুল বাস থেকে নামার সময় জোর করে ধরে আবর্জনার বালতিতে ফেলে দিত’, বলেন ফ্রেডি। এক পর্যায়ে তার বাবা তাকে নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন, কিন্তু বাচ্চারা তাকেও ব্যঙ্গ করত।
কিন্তু ফ্রেডির কাছে তার বাবা-মা ছিলেন হিরোর মতো। ফ্রেডি জানান, তিনি তার বাবাকে দেখেছেন সবসময় মানুষকে সাহায্য করতে, আশ্রয়হীনদের খাবার দিতে। সপ্তাহান্তে তারা বাবা-ছেলে মিলে ডাম্পস্টার ক্যানের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজতেন, বিশেষত ফ্রেডি চাইতেন একটি কম্পিউটার। তারপর একদিন ২৪ ডলারের বিনিময়ে একটি ভাঙা ম্যাকিন্টশ কম্পিউটার কিনে আনেন এক দোকান থেকে। কিন্তু বাড়ি ফিরেই ফ্রেডি তার ভাঙা কম্পিউটারকে চালু করতে উঠেপড়ে লাগলেন। আগে থেকেই তার রেডিও, অ্যালার্ম ঘড়ি ইত্যাদি সংগ্রহের বাতিক ছিল। সেগুলো থেকে নানা যন্ত্রাংশ অদলবদল করে লাগানোর পর অবশেষে ৫০ বারের চেষ্টায় ফ্রেডি তার কম্পিউটারকে চালু করতে পেরেছিলেন। আর সেই মুহূর্ত থেকেই ফ্রেডি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি বাকি জীবন প্রযুক্তি দুনিয়ার মধ্যেই পার করতে চান।
১২ বছর বয়সে ফ্রেডির প্রতিভা প্রথম বাইরের মানুষের নজরে আসে। অবসর সময়ে তিনি স্কুলের ল্যাবের নষ্ট কম্পিউটারগুলো ঠিক করতেন, আর সেটিই স্কুলের পরিচালক তথা কুইন্সির মেয়রের চোখে পড়ে। এরপর তিনি তাকে সিটি হলে ডাকেন এবং অন্তত ১০০ কম্পিউটার ঠিক করে দিতে বলেন। কম্পিউটারগুলো ঠিক করতে প্রতি ঘন্টার জন্য ১২ ডলার করে ফ্রেডি পাবেন বলে মেয়র জানান। ফ্রেডির কাছে এ কাজ শুধু টাকার জন্য ছিল না, বরং নিজের প্রিয় এই কাজটা করতে পারাই ছিল তার কাছে আনন্দের।
এর কয়েক বছর পর কোডিং করার একটি সুযোগ তার সামনে আসে। কুইন্সিতে শহরের পানির চাপ মাপার জন্য একটি প্রোগ্রাম তৈরির প্রয়োজন হয়, যার জন্য এক কোম্পানি ৬০০,০০০ ডলার দাবি করে। কিন্তু ফ্রেডি সেই কাজ করে দেন খুব কম মূল্যে।
১৫ বছর বয়সে ফ্রেডি স্কুল ছেড়ে দিয়ে নিজের কম্পিউটিং ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। এটা ছিল তার জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট, যদিও বাবা-মা এতে রাজি ছিলেন না। ফ্রেডির ব্যবসা ভালোই চলছিল, কিন্তু দুই বছর পরেই তার বাবা নাথান আলঝেইমারস রোগে আক্রান্ত হন। তখন থেকে তিনি অদ্ভুত আচরণ করতেন যা ফ্রেডির জন্য কষ্টকর মুহূর্ত ছিল। এক সকালে উঠে তিনি বাবাকে ঘরে দেখতে পেলেন না। বাবা যাতে নিখোঁজ না হন, তাই তিনি বাবার জুতার তলায় একটি সার্কিট বোর্ড বসিয়ে ৯০ মেগাহার্টজ এর স্পিকার লাগিয়ে দেন। সাথে একটি মাইক্রোফোন ও অয়্যার্ড এরিয়া নেটওয়ার্ক কার্ড বসিয়ে দেন। এটি তিনি নিজের ল্যাপটপের সাথে সংযুক্ত করেন। ফলে বাবা যেখানেই যাবেন, তিনি বুঝতে পারবেন। ফ্রেডি জানান, তার এই প্রযুক্তি ছিল গুগল ম্যাপ বা অ্যাপল ম্যাপেরও আগে তৈরি।
২০১৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর ফ্রেডি তার এই ‘শ্যু ট্র্যাকার’ প্রযুক্তি ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দেন। বাবা নাথানের সবসময় একটি ১৯৯৩ ফোর্ড পিক-আপ ট্রাক এবং মাছ ধরার নৌকা কেনার শখ ছিল। কিন্তু যখন ফ্রেডির কাছে সেসব কেনার মত টাকা এলো, ততদিনে বাবা আর নেই।
‘এই ঘটনা আসলে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি যে টাকা স্রেফ একটা যন্ত্রাংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি নিজে মারা যাওয়ার আগে পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু করতে চাই যেভাবেই হোক।’ ২২ বছর বয়সে ফ্রেডি ‘স্মার্ট গ্লুকোমিটার’ আবিষ্কার করেন যা তাৎক্ষণিকভাবে একজন ব্যক্তির ব্লাড সুগারের মাত্রা তার স্বজনদের জানাতে পারবে এবং ইলেকট্রিক হেলথ রেকর্ডে তা জমা থাকবে। কারো ব্লাড সুগার মাত্রা অস্বাভাবিক হলে তখনি যন্ত্রটি সতর্কবার্তা দিবে।
২০১১ সালে ফ্রেডি আমেরিকার সর্বকনিষ্ঠ টেলিকম অপারেটর হন বলে বিবিসি সূত্র জানায়। তিনি ‘ফিগারস কমিউনিকেশন’ এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সাউদার্ন জর্জিয়া, ফ্লোরিডার গ্রাম্য এলাকাগুলোতে উন্নত মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা নিশ্চিত করেন। এছাড়াও তিনি ‘ফিগারস এফ ১’ নামক একটি স্মার্টফোনও বের করেন। ‘ফিগারস এফ ৩’ বর্তমানে এফসিসি কর্তৃক অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। ফ্রেডি জানান, তার লক্ষ্য হলো কম খরচে উন্নত মানের সেবা নিশ্চিত করা।
ফ্রেডির মায়ের বয়স এখন ৮৩ বছর এবং তিনিও আলঝেইমারসের রোগী। কিন্তু তিনি ফ্রেডির অর্জনসমূহ নিয়ে ভীষণ গর্বিত। ২০১৫ সালে ফ্রেডি পেশায় অ্যাটর্নি, নাটালি ফিগারসকে বিয়ে করেন এবং এ দম্পতির এখন একটি মেয়ে আছে।
ফ্রেডি বলেন, ‘আমি আমার ছোট্ট মেয়েকে জীবন সম্পর্কে একটা কথাই বলতে চাই যে, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেন; কখনো হাল ছেড়ে দেবে না। জীবনে যত মানুষের সাথেই দেখা হবে, চেষ্টা করবে তাদের উপর সুন্দর প্রভাব রাখার, পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলার। ‘
সূত্রঃবিবিসি