টানা ১১ দিন সংঘাতের পর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরাইল ও হামাস। এই সময়ে গাজায় নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে ইসরাইলি বিমান বাহিনী। হাজার হাজার বোমা ফেলেছে বাংলাদেশের একটি ছোট জেলার আয়তনের সমান অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৩০ ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন ১৯০০ জনেরও বেশি। লাখো মানুষ হারিয়েছেন তাদের আশ্রয়। এর পাল্টা জবাবও দেয়ার চেষ্টা করেছে গাজার সশস্ত্র যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস। ইসরাইলের বিভিন্ন শহরকে টার্গেট করে ছুঁড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার রকেট।
এতে ইসরাইলে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১২ জন। হামাসের রকেট বৃষ্টিতে কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে ছিল ইসরাইলের বেশিরভাগ অঞ্চল।
এই রক্তপাত বন্ধে বিভিন্ন দেশ থেকে চাপ আসলেও তাতে সাড়া দেননি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুধবার ফোন করে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। এরপরও নেতানিয়াহু হামলা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে তখনই হামাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, দুই-একদিনের মধ্যেই কার্যকর হতে যাচ্ছে যুদ্ধবিরতি। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। প্রথম থেকেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মতো ইসরাইলকে একতরফা সমর্থন দিয়ে আসছিলেন বাইডেন। গাজায় ইসরাইলের তাণ্ডবকে সমর্থন করে জানিয়েছিলেন, এটি ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার। তবে বাইডেনের এমন অবস্থান সমালোচিত হয়েছে নিজ দলের মধ্যে, চাপও আসতে থাকে তার ওপর। তার চেষ্টার পরেই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ইসরাইল। এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বাইডেন। তিনি বলেন, ‘ইসরাইলের আয়রন ডোম-মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনরায় গড়ে তুলতে সাহায্য করবে যুক্তরাষ্ট্র। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে। আমি এ অঞ্চল নিয়ে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে থেমেছে দুই পক্ষই। এখন প্রশ্ন উঠেছে রক্তক্ষয়ী এ সংঘাতে জয়ী হয়েছে কে?
শুক্রবার থেকে গাজায় পণ্য চলাচল পুনরায় চালু করবে ইসরাইল। ফলে গাজাবাসীর জীবন সহজ হবে। ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো যদিও এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে। হামাস কতদিন ইসরাইলে হামলা বন্ধ রাখবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তারা। ইসরাইলি কয়েকজন জেনারেলকে উদ্ধৃত করে টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, এই যুদ্ধবিরতি হয়তো ৫ মাস কার্যকরি থাকবে, ৫ বছর কখনই নয়। হামাস নেতারাতো হুঁশিয়ারি দিয়েই বলেছেন, যুদ্ধবিরতি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এখনো ট্রিগারে হাত রয়েছে। ফলে এটিকে ইসরাইলের জন্য ওই অর্থে বিজয় বলা যাচ্ছে না। যদিও উভয় পক্ষই নিজেদের বেশকিছু অর্জনের দাবি করেছে। সবমিলিয়ে বলা চলে, মধ্যম সময়ের হিসেবে হামাসই এই যুদ্ধে বড় জয়ী। তবে একেবারে নিকট ভবিষ্যতে দেখলে বোঝা যাবে, এই সংঘাতে বিজয়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
কিভাবে? সহজ কথায় বললে, নেতানিয়াহু এখন অনেকদিন পর তার বেলফোর স্ট্রিটের বাসভবনে আরামে ঘুমাতে পারবেন। সেই সুযোগ তাকে করে দিয়েছে হামাসের সঙ্গে সাম্প্রতিক এই সংঘাত। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। মাসের পর মাস পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। সেই বিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিতো। একাধিকবার তাকে পদত্যাগ করার জন্য সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু এই সংঘাত প্রমাণ করেছে, ইসরাইলিদের একজন নেতানিয়াহুর বিকল্প নেই। নেতানিয়াহুর এই বিজয়ের কথা এরই মধ্যে প্রচার হচ্ছে ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলোতেও।
অপরদিকে জয়ী হয়েছে হামাসও। হামাসের রাজনৈতিক শাখার জ্যেষ্ঠ নেতা নিজেদের বিজয়ী দাবি করেছেন। শুক্রবার দেয়া এক ভাষণে হামাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা খলিল আল হায়া বলেন, এটি আনন্দের বিজয়। এর মধ্যদিয়ে সংগঠন হিসেবে হামাস ফিলিস্তিনতো বটেই, সমগ্র আরব বিশ্বেই নিজের ব্যাপক সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছে। আঞ্চলিকভাবে গাজায় নিজের অবস্থান আরো দৃঢ় হয়েছে তাদের। যেই পশ্চিম তীরে হামাস বিরোধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেও হামাসের পক্ষে জনমত প্রবল হয়েছে। আদর্শ ভিন্ন হলেও ফিলিস্তিনিরা নিজেদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন। গাজায় ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে সমগ্র পশ্চিম তীরেই আন্দোলন হয়েছে। সচরাচর এমনটা দেখা যায়না। আর এই ফিলিস্তিনি ঐক্য রাতারাতি সম্ভব না হলেও, হামাসের প্রতি মানুষের সমর্থন বৃদ্ধি কিন্তু স্পষ্ট। হামাস প্রথম যখন ইসরাইলে রকেট হামলা চালিয়েছিল, সংগঠনটি নিশ্চিতভাবেই জানতো এর পরিণতি কী হবে। এই সংঘাত সাময়িকভাবে হামাসকে দুর্বল করে দিলেও এটি ফিলিস্তিনে তাদের প্রভাব বিস্তারের পথ সুগম করে দিয়েছে।
কিন্তু উভয় পক্ষই যদি জয়ী হয় তাহলে এই সংঘাতে হার হয়েছে কাদের? নিঃসন্দেহে হেরে যাওয়া দল হচ্ছে দুই পাশের সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে গাজাবাসী। ইসরাইল গাজায় হামলার ক্ষেত্রে কখনোই মানবাধিকারের তোয়াক্কা করেনি। গত ১১ দিনের হামলায় গাজায় ২৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে আছে অন্তত ৬৫ শিশু এবং ৩৬ নারী। ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায় ৫০০ আবাসিক ভবন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সহস্রাধিক। ইসরাইল হামলা করেছে স্কুল, হাসপাতাল এমনকি শরণার্থী শিবিরেও। স্থানচ্যুত হয়েছেন লক্ষাধিক গাজাবাসী। গত কয়েকটি দিন তাদেরকে সার্বক্ষণিক মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে বাঁচতে হয়েছে। এমন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য ইসরাইলকে হয়তো প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হবে না কখনো।
কৌশলগত জায়গা থেকে বিবেচনা করলে হামাসের খুব বেশি অর্জন নেই যুদ্ধ থেকে। সংগঠনটির ছোড়া বেশিরভাগ রকেটই ইসরাইলের আয়রন ডোম আকাশেই ধ্বংস করে দিয়েছে। ইসরাইলের দাবি আয়রন ডোমের কার্যকরিতা ছিল ৯০ শতাংশেরও বেশি। তারপরেও দেশটিতে অনেকগুলো রকেট আঘাত হেনেছে। অনেক ইসরাইলি হতাহত হয়েছে। সবমিলিয়ে ইসরাইলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়েছে। তবে হামাসের অর্জন মূলত রাজনৈতিক। ফাতাহ এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রভাব খর্বে এই সংঘাত প্রচুর সাহায্য করবে। টাইমস অব ইসরাইলতো দাবি করেই বসেছে যে, এই সংঘাতে ইসরাইল ছিল হামাসের দ্বিতীয় টার্গেট। প্রথম টার্গেট ছিল আসলে ফাতাহ।
হামাসের আরেকটি অর্জন অনেকটা চোখের অগোচরেই রয়ে গেছে। সেটি হচ্ছে, হামাস সফলভাবে ইসরাইলের মধ্যেই দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পেরেছে। অর্থাৎ, ইসরাইলিরা নিজেদের মধ্যেই অস্থিরতা তৈরি করেছে একাধিক শহরে। দেশটির মোট জনগণের ২০ শতাংশই আরব মুসলিম। তাদের একটি অংশ ফিলিস্তিনকে ভালোবাসেন এবং তাদের ওপর ইসরাইলি নিপীড়নের ঘোর বিরোধী। কিন্তু এতোদিন তাদেরকে সক্রিয় দেখা যায়নি। এবার সেই পরিস্থিতিটা পাল্টে দিয়েছে হামাসের এই প্রতিরোধ যুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হতে হবে এমন আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ইসরাইলি আরবরা সক্রিয় প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। এটি ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্যেও একটি সাবধান বার্তা।
হামাস ভালো করেই জানে, ইসরাইলের বিমান হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাতার থেকে আসা অর্থে সামলে নেয়া যাবে। আবার ইসরাইলও এই অর্থের প্রবাহ অব্যাহত রাখতে সব সুযোগ করে দেবে। এটা সেখানে একটি পুরোনো খেলা। হামাস নেতা খলিল আল হায়া শুক্রবারই জানিয়েছেন, ইসরাইলি হামলায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি পুননির্মাণ করে দেয়া হবে। ইসরাইলও কখনো হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে চায়নি। নিজেদের স্বার্থেই তারা হামাসকে গড়তে দিয়েছে, টিকে থাকতে দিয়েছে। হামাসের অবস্থান নিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যে অনৈক্য রয়েছে তা একতরফাভাবে ইসরাইলকেই সুবিধা দিয়ে আসছে।
ইসরাইলের ইতিহাসের সব থেকে বেশিদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন নেতানিয়াহু। হামাসকে নিয়ে ইসরাইলের এই কৌশল বাস্তবায়নে সব থেকে বেশি ভূমিকাও তার। এটিতে ইসরাইল সফল হলেও এ নিয়ে প্রবল সমালোচনাও চলেছে দেশটিতে। টাইমস অব ইসরাইল বলছে, নেতানিয়াহুর এই নীতি হামাসকে একটি সশস্ত্র সংগঠন থেকে সামরিক বাহিনীতে পরিণত করেছে।