একঃ রাশিয়ান সাহিত্যে তিনজনকে সাধারণত দিকপাল হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তারা হলেন দস্তয়েভস্কি, পুশকিন এবং টলস্টয়। তাদের মধ্যে দস্তয়েভস্কিকে সাহিত্যিকের সাহিত্যিক বলা হয়। উনার ক্রাইম আন্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসেটি একটা অনবদ্য সৃষ্টি। উপন্যাসের নায়ক একজন খুবই প্রতিভাবান দরিদ্র ছাত্র, যে নিজেদেরকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা এবং উন্নত প্রজাতির বলে মনে করে। সে মনে করে যে, তাকে এমন বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে যে, সেই অধিকারবলে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করে ছাড়বে। কিন্তু কোন দুর্গতি থেকে সে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করবে সে বিষয়ে বিস্তর ধারনা তার নাই। এই বিশেষ অধিকার বলে সে সকল প্রকার মানবিক ও সামাজিক নিয়মের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এবং একজন সুদখোর মহিলাকে হত্যা করে। যে পদ্ধতিতে সে সুদখোর মহিলাটিকে খুন করে, তাতে প্রমাণের দাগ পর্যন্ত ছিল না, পুলিশ তাকে ধরতে পারে না। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় ছিন্নভিন্ন হতে হতে রাসকলনিকভ একই সঙ্গে ধারণ করে আততায়ীর হিংস্রতা ও দণ্ডিতের অসহায়তা। এভাবেই সে দিনের পর দিন শাস্তি পেতে থাকে। এখানে সে, যে মহিলাকে খুন করে সে সমাজের জন্য একজন ক্ষতিকর মহিলা ছিল এবং সমাজের বৃহৎ স্বার্থে সে আইন আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে পরবর্তীতে অনুশোচনায় কষ্ট পেতে থাকে।
দুইঃ রসায়নে রাসায়নিক সাম্যাবস্থা নামে একটা টার্ম আছে। কোন একটি বিক্রিয়া যখন শুরু হয় তখন বিক্রিয়ার শুরুতে বিক্রিয়কগুলোর ঘনমাত্রা অনেক বেশি থাকে, এরপর বিক্রিয়া সম্মুখদিকে অগ্রসর হয়। তখন বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা কমতে থাকে এবং উৎপাদের ঘনমাত্রা বাড়তে থাকে। উৎপাদের ঘনমাত্রা একটা পর্যায়ে পৌঁছানোর পর উৎপাদ আবার বিক্রিয়কে পরিণত হয়। এ বিক্রিয়াকে পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়া বলে। বিক্রিয়ার শুরুতে কিন্তু সম্মুখমুখী বিক্রিয়ার গতি অনেক বেশি থাকে। এরপর আস্তে আস্তে এ গতি কমতে থাকে এবং পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার গতি বাড়তে থাকে। একসময় সম্মুখমুখী ও পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার গতি সমান হয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলে রাসায়নিক সাম্যাবস্থা।
আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতেও ঠিক একই ভাবে সাম্যাবস্থা বিরাজ করে, যেটাকে আমরা ন্যাচারাল ল বলে থাকি। যখন ব্যাপকভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে থাকে তখন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তবে,এই সাম্যাবস্থা ঠিক করার উদ্যোগ প্রকৃতি নিজেই নিয়ে নেয়। গত কয়েক দশকে ব্যপকভাবে পরিবেশ দুষণ ঘটেছে এবং খুব সম্ভবত তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই করোনাভাইরাসের উদ্ভব। এই করোনা ভাইরাসের ফলে বিশ্বের প্রায় সবদেশে লকডাউন চলছে, গাড়িঘোড়া, কলকারখানার দুষণ অনেক কমে গেছে। যার ফলে পরিবেশে আবার আস্তে আস্তে পূর্বের অবস্থানে ফেরত যাচ্ছে। ইউরোপে গত কয়েক দশকের মধ্যে এবারই প্রথম প্রচুর বরফপাত হয়েছে এবং ঠান্ডাও অনেক দীর্ঘস্থায়ী ছিল, যেটাই সাধারণত ইউরোপের ন্যাচারাল ল। তবে ন্যাচারই যে সব সময় এই কাজ করে তা কিন্তু না, কিছু কিছু অমানুষ নিজের অজান্তেই এরকম কাজ করে বসে। চেংগিচ খান তার জীবদ্দশায় সেইবসময় মোট জনসংখ্যার পারায় ৮% মানুষ মেরে ফেলেছিলেন। যা প্রায় দশ কোটির সমান, বলা হয় যে, তার জন্যও সেসময় পরিবেশের দুষন অনেক কমে গিয়েছিল।
তিনঃ মানুষের শরীরেও সাধারণত ন্যাচারাল ল বিরাজ করে, যখন কোন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে আক্রমণ করে, আমাদের শরীরের শ্বেত কণিকারা শরীরকে সাম্যাবস্থায় আনতে প্রাণপণ লড়াই করে যায়। ঠিক একইভাবে ন্যাচারাল ল ধনী গরিবের ভিতরেও একটা ব্যালেন্স তৈরি করে দেয়। প্রথমত খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে। ধনী মানুষের খাবার দাবার সাধারণ দামী ফাস্ট ফূড, তৈলাক্ত রেডমিট, হোটেল রেস্টুরেন্টের খাবার আরও অনেক অস্বাস্থ্যকর খাবার, যেটা ধনী মানুষের অসুস্থ করতে বেশি সময় নেয় না। তাছাড়া বিভিন্ন দামী দামী নেশাজাতীয় দ্রব্যতো আছেই। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে কঠিন কঠিন রোগ বালাই সাধারণত ধনী লোকেরই বেশি হয়। অপরদিকে গরিব মানুষের খাবার সাধারণত লাল সিদ্ধ চাল, গমের আটা, কমদামি শাকসবজি ইত্যাদি এবং তারা সাধারণত টাকার অভাবে এগুলো সবই রান্না করে খায়। এগুলো সব কমদামী হলেও বেশিরভাগই খুবই স্বাস্থ্যকর, সেজন্য তারা সুস্থও থাকে এবং তাদের জৈবনিক শক্তিও অনেক ভালো থাকে। এর বাইরে দেখা যায় যে, যে মানুষগুলো বড় বড় মর্যাদার কাজ করে এদের সাধারণত শারিরীক পরিশ্রম অনেক কম, সারা দিন আরামকেদারায় বসে বসে অফিস করে। এদের শরীরেই সাধারণত বাসা বাধে সকল ধরনের রোগবালাই, থাকে না পারিবারিক সুখ শান্তি। অপরদিকে যে মানুষগুলো শ্রমিকের কাজ করে, মাঠে ঘাটে কাজ করে বেড়ায় তারা সাধারণত শারিরীক ভাবে ফিট থাকে এবং এদের অসুখ বিসুখ অনেক কম হয়। একইভাবে, যে মানুষগুলো সবসময় চলাচলের জন্য দামী গাড়ি ব্যবহার করে তারা তাদের নিত্যদিন যে পরিমান হাটাচলা প্রোয়জনীয় সেটা ভুলে যায় একই ভাবে পরিবেশ দুষণও করছে। সুতরাং পরিবেশ যে তার প্রতিশোধ নিবে এটাই স্বাভাবিক, আর তার জন্য আছে হাজারো রোগ বালাই। অন্যদিকে যে মানুষগুলো টাকার অভাবে পায়ে হেঁটে চলে অথবা বাইসাইকেলে চলে তারা নিজের অজান্তেই ঠিক কাজটাই করছে, তারা থাকে সুস্থ।
একইভাবে দেখা যায় যে, যারা প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক নিত্যদিনের খাওয়া পরার চিন্তা তাদের করা লাগে না, তখন তাদের মাথায় ভরকরে যতরাজ্যের আকাম চিন্তা, ফলে দেখা যায় যে তারা হাজারো অসামাজিক কাজ এবং অসামাজিক সম্পর্কে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে। ফলে সাংসারিক এবং ব্যক্তিগত জীবননে তৈরি হয় অশান্তি। অন্যদিকে, যারা পেটের চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাদের অন্য ঝামেলায় যাওয়ার মত সময় ও শক্তি অবশিষ্ট থাকে না, তারা পারিবারিক ভাবে বেশ খুখি হয়।
উপসংহারঃ আইন্সটাইনের একটা বিখ্যাত উক্তি হল “God does not play dice” এর মাধ্যমে উনি বুঝাতে চেয়েছেন প্রকৃতির এই যে হারমনি, রিদম, শৃঙ্খলা এগুলো কি র্যান্ড্যামলী হওয়া সম্ভব??? পাশা খেলার মত ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে এগুলো কি আসলেই হতে পারে?? আইন্সটাইন কোন মংগলময় ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, যিনি মানুষের খাওয়া পরা, নাচ গান, পাপ পুর্নির হিসাব করে বেড়াবেন। খুব সম্ভবত উনার মতে ঈশ্বর হল একধরনের শক্তি যা মহাবিশ্বের সবকিছুকে শৃঙ্খলভাবে ধরে রেখেছেন। আমার কাছেও তাই মনে হয় এখানে পাপ, পুর্নি সবকিছুর হিসাব প্রাকৃতিক নিয়মে হয়। যার জন্য মরার পর স্বর্গ নরকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। কিন্তু সকল ধরনের ধর্ম যে মানুষের তৈরি সেটা বোঝার জন্য খুব বেশিপড়ালেখার দরকার হয় না। এজন্য আজও যখন দেখি ধর্মের নামে মারামারি, হানাহানি হচ্ছে, তখন অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আজ ফিলিস্তিনের মানুষের যে রক্ত ঝরছে, সাধারণ বিবেকবান মানুষ হিসাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ তার জন্য কোন ধর্ম লাগে না। সকল ক্ষমতার প্রাকৃতিক নিয়মে একদিন শেষ আছে, ঠিক তেমন আজকের এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনেরও একদিন পতন হবে। কিন্তু মানুষ যদি সময়ের সাথে নিজেদেরকে পরিবর্তন না করে, যদি আধুনিক না হয়, তাহলে এই আরব বিশ্ব আরও বহুকাল এদের হাতে মার খাবে। আর তাদের জন্য সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।