কলিংবেলে চাপ দিতেই সেটা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের মত চিৎকার করে বেজে উঠলো । একটু চমকে বাটন থেকে হাতটা সরিয়ে নিল রহমত। অনেকক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নাই। তারপর একটা আধ ছেঁড়া ময়লা দু’ টাকার নোট দো’তলার গ্রিল থেকে বাতাসে ভেসে পায়ের কাছে এসে পড়ল। একটু আনন্দও হল। বেশভূষা আর কাঁধের ঝোলাটায় একেবারে পারফেক্ট ভিক্ষুক। টাকাটা কুড়িয়ে আবার চাপ দিলে বেল এ। এবার এক সুদর্শন নওজোয়ান এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার চমকালো রহমত ।সেই চোখ ! মুখের আড়াটাও একই রকম ।
–ভিক্ষার জন্য আসিনি বাবা,একটু কথা বলতে চাই। বিনয়ের সঙ্গে জানায়।
–কথাতো আদ্যিকালের পুরনো। হয় ছেলের অসুখ নয়তো বউয়ের ক্যান্সার।সাহায্য চাই ।ওসব হবে না ।এবার বিদায় হও।
–তোমার অনুমানশক্তি ভালো। সত্যিই আমার বউয়ের ক্যান্সার।চিকিৎসার জন্য এই মুহূর্তে অনেক টাকার প্রয়োজন ।সে বিষয়ে একটু কথা বলতে চাই।
একটু হেসে ছেলেটা নিচে নেমে এসে হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–এখানে কোন ডাক্তার নাই ।আর গতানুগতিক ধান্দাবাজি ছেড়ে ব্যবসায় ক্রিয়েটিভ কিছু বের করো তাহলেই সামনে আগাতে পারবা। ছেলেটাকে একটু ভড়কে দেবার জন্য রহমত শুদ্ধ ইংরেজিতে উচ্চারণ করলো
–I am a slow walker but never walk back
ইংরেজি ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে। ছেলেটাকে বিভ্রান্ত করা গেছে।তুমি থেকে আপনি তে উঠে সরু চোখে তাকিয়ে বলল ,
–কে আপনি ?কাকে চান ?
চোখেমুখে সন্দেহ স্পষ্ট ।
–আমি এই বাড়ির মালিকের সাথে দেখা করে কিছু কথা বলতে চাই।
–চোর-ডাকাত নন তো?
–ওসব করতে যে শক্তি আর সাহস লাগে তা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে আমার।
–বাবা বাড়িতে নেই।কখন আসবেন তারও ঠিক নেই ।
–উনি তো অনেক বছর যাবৎ এ বাড়িতে আসেন না। তাহলে তার কথা আসছে কেন?
–সব খোঁজখবর নিয়েই এসেছেন দেখছি। নিচতলার ভাড়াটিয়া একটু উঁকি দিতেই তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ছেলেটা চট করে রহমতকে উপরে নিয়ে গেল।
বসবার ঘরটা অনাড়ম্বর কিন্তু বেশ ছিমছাম। বসতে বসতে ছেলেটা বলল,
–অতিথিকে চা-বিস্কুটে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ রক্ষা করতে পারছিনা বলে দুঃখিত, কারণ ঘরে ওসব কিছু নাই।এবার বলুন কি বলবেন।
–তোমার সঙ্গে নয় আমি এই বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আর শোনো,আমি চা খাই না। কফি খাই ।
কাঁধের ঝোলায় হাত দিয়ে তিন প্যাকেট রেডিমিক্স ইনস্ট্যান্ট কফি প্যাকেট বের করে তা ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল,
–একটু গরম পানিতে গুলিয়ে নিয়ে এসো। ঃআপনি কি এসব সাথে নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন? ঃহ্যাঁ ।এই করোনা মহামারীতে বাইরের কিছু খাই না তো তাই তেষ্টা পেলে ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে চেয়ে একটু গরম পানিতে গুলিয়ে নেই।
–মানুষ তো দুইজন। তিন প্যাকেট দিচ্ছেন কেন?
–আরেকটা তোমার মায়ের জন্য।
–উনি মারাত্মক অসুস্থ এসব খাওয়া বারণ ।
–যে মানুষটার বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট না করলে কয়েক মাসের মধ্যে মারা যাবে তার খাদ্য তালিকা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো।
ছেলেটা এবার একটু আক্রমণাত্মক এবং রূঢ় ভাবে বলে উঠলো,
–স্পষ্ট করে বলুন তো আপনি কে ? এত খবর জেনে এসেছেন উদ্দেশ্যটা কি? দয়াকরে দার্শনিকের মত বলবেন না, আই এম নো বডি। ঃবাবা আসলেই আমি কেউ না ।তুমি পানি গরম করে নিয়ে এসো। তিনজন কফি খেতে খেতে কথা বলি।
–মা’র শরীর এতটাই খারাপ যে তার পক্ষে বিছানা ছেড়ে উঠে আসা সম্ভব না ।
–অবশ্যই সম্ভব । তুমি যেয়ে বল,’সামথিং ইজ বেটার দেন নাথিং এসেছে। ‘ঠিক উঠে আসবে। একটু পর ছেলেটি বিস্ময় আর জলভরা চোখে মাকে এক হাতে জাপ্টে ধরে নিয়ে এলো। হয়তো অনেকদিন তার মা হাঁটাচলা করেনি। হাসেনি।কথা বলেনি । মুহূর্তের মধ্যে এত বড় পরিবর্তন দেখে ছেলেটি নিজেকে সামলাতে পারছে না। অনবরত চোখ মুছছে । মায়ের মত নাকের ডগা টা লাল হয়ে আছে ।
রাহেলা হাসছে । দুপাটির দুপাশের ক্যানাইন পড়ে যাওয়ায় মিকি মাউস এর মত লাগলেও শিশুর সারল্যে কি সুন্দর হাসি ।
ছেলেটা কফি বানাতে গেল আর দেমাগের ইউটিউবে অটো টিউন হয়ে গেল তিরিশ বছর আগের সেন্সর বোর্ডে আটকে যাওয়া সিনেমা ।
ওপি ওয়ান লটারিতে আমেরিকা যাওয়ার টিকিট পেয়ে যেন স্বর্গের সারথি হয়ে গেল রহমত।ব্যাংকের কেরানি বলে যারা ঠোঁট ওল্টাতো তারাই জামাই বানাতে লাইনে চলে এলো।কিন্তু কলেজগেটে দেখা রাহেলা যেন মাথাটাই নষ্ট করে দিয়েছিল ।কবি বুঝি এই মেয়ের চুলের বর্ণনায় রচনা করেছিলেন, ‘সই ভালো করে বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে’ কিংবা ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’ কবি-সাহিত্যিকরা দিঘির জলে এই কাজল কালো চোখ দুটিই বুঝি খুঁজেছে যুগে যুগে ।এই হাসিই বাঁধ ভাঙা চাঁদের হাসি। হৃদয়ে সুর বাজে,এক তুহি ধনবান গোরি বাকি সব কাঙ্গাল।
রহমত সত্যিই সেদিন কাঙালের মতোই চেয়েছিল রাহেলাকে ।বেশি বেগ পেতেও হলো না। আমেরিকার ভিসার দমকা হাওয়ায় কাত হয়ে গেল রাহেলার দাপুটে পরিবার।সাত দিনের নোটিশে তিন অক্ষরের তিন কথায় এক লক্ষ টাকার কাবিনে বিয়ে হয়ে গেল রহমত-রাহেলার। কিন্তু লাখ কথার বিয়ে তিন কথায় শেষ হওয়ার দূর্ভাগ্যজনক পরিণতির জন্য কোন প্রস্তুতিই ছিল না রহমতের। বিয়ের রাতে একলা একান্ত পরিবেশে রাহেলার প্রথম কথা ছিল,
–আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন? রাত পোহানোর আগেই আমি আমার পছন্দের প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাব। তখন আপনার কি হবে?
রহমতের তখন সমাপ্তি গল্পের কথা মনে পড়লো। মৃন্ময়ীও ঠিক এ রকমই বলেছিল অপূর্বকে। একদিন পালিয়েও গিয়েছিল কিন্তু শেষটায় তো সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। রাহেলা ও ঠিক হয়ে যাবে ।তারপর রাহেলা যা বলেছিল তা আরো ভয়াবহ এরকমভাবে আগেও নাকি তার কয়েকবার বিয়ে দিয়ে লাখ টাকার কাবিন করে ছেলে পক্ষের নিকট থেকে বলপূর্বক আদায় করা হয়েছে ।কোন ডিভোর্স হয়নি।তারা যদি এসে স্বামীত্ব দাবী করে তাহলে কি হবে। আতঙ্কে শিউরে ওঠে রহমত। প্লেন ভাড়ার টাকা যোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছে।কাবিনের লক্ষ টাকা কোথায় পাবে সে ।সে সময় লাখ টাকার মূল্যমান তো কম ছিল না।রাহেলার পরামর্শমতো রাতের আঁধারে পালিয়ে আসে রহমত। পরদিন সকালে টক অব দ্যা টাউন হয়ে গেল যে রহমত আদতে ক্লীব। এজন্যই পালিয়ে গেছে। মাসখানেকের মধ্যেই রাহেলার বিয়ে হয়ে গেল তার পছন্দের ছেলেটার সাথে। সেই যে মুখে চুনকালি মেখে বাড়ী ছাড়লো আর ফেরা হলো না।
আমেরিকার রাজপথে ফুল বিক্রি থেকে শুরু করে হোটেলের মাছ মুরগি কেটে সাফ করা, ড্রাইভিং, কাপড় ইস্ত্রি,কি করে নাই সে। তারপর কপাল ফিরল হাউজিং ব্যবসায় ।
এত বছর পর ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পারে রাহেলা অসুস্থ ।বোনম্যারো প্রতিস্থাপন না করলে বাঁচার আশা নেই ।সেজন্য অনেক টাকার প্রয়োজন ।ডোনার তারই ছেলে। খবরটা জেনেই ঠিকানা বের করে রহমত ছুটে এসেছে দেশে ।বিষন্ন রাহেলা তার পান্ডুর মুখখানা তুলে অস্ফুটে বলল,
–সেদিনের এক অবুঝ কিশোরীর কল্প কথায় দাবি ছেড়ে জঘন্য অপবাদ মাথায় নিয়ে পালিয়ে গেলেন কেন ?অন্ধ আবেগে কতই না মিথ্যে বলেছিলাম।
–অনেক দেরিতে যখন জানলাম সব মিথ্যা তখন ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাহেলা।
–আপনার সংসার। ছেলে মেয়ে।
–যাকে ভালোবাসি তাকে ছোট করি কি করে। তাই তোমার মিথ্যে প্রচারণাটাকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছি ।চলেই তো গেল জীবন। আর কয়দিন। তাছাড়া আইনত একজন স্ত্রী তো আমার আছেই। দাবি করলে তা এখনো করতে পারি ।
একটু স্মিত হেসে রাহেলা বলল,
–এতদিন বাদে এই মিসকিনের বেশে কেন ?
–আমি তো তোমার কাছে চিরদিনের ভিখিরি।এসেছি তোমাকে চোখের দেখা দেখতে আর দেনা শোধ করতে।
–দেনা ? উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় রাহেলা
–হ্যাঁ তাই । আমেরিকা গিয়ে প্রথম রোজগার থেকে তোমার কাবিনের এক লক্ষ টাকার সমপরিমাণ ডলার একটি দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করেছিলাম। এতদিনে সুদে-আসলে তার পরিমাণ যা দাঁড়িয়েছে তাতে তোমার চিকিৎসার ব্যয় মিটে যাবে আশা করি।কেউ যাতে বুঝতে না পারে তাই টাকা গুলো এই বেশে ঝুলিতে করে নিয়ে এসেছি।
রহমত ঝোলাটা এগিয়ে দেয়। রাহেলার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে ।তিরিশ বছরের মিথ্যের জঞ্জাল ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে।
সেই মেঘ মালার মতো চুল পড়ে গেছে কেমোর প্রভাবে।মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে শুকনো গালে। একটু ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছেটা বহুকষ্টে দমন করল সে।
–ছেলের বাবা চলে গেল কেন ?
জানতে চাইলো রহমত ।
–মিথ্যে আবেগে আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম কিন্তু ও আমাকে ভালোবাসে কি না তা কখনো পরখ করিনি। তাই হয়তো তার পছন্দের কাউকে নিয়ে সংসার করছে।ওসব নিয়ে আর ভাবিনা। ছেলের বিয়ে দিয়েছি। ছোট একটা নাতি ও আছে। এদের নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনতে মন্দ লাগে না।
–ঠিক আমার মতোই। আমিও কখনোই জানতে চাইনি তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা।
স্বগতক্তি করে রহমত।
তারপর দুজনেই চুপচাপ চেয়ে থাকে একে অপরের পানে।
ছেলেটা কফি নিয়ে এসেছে।একটু চুমুক দিয়ে জানতে চাইল
–সামথিং ইজ বেটার দেন নাথিং- কথাটা শোনামাত্র মা সুস্থ হয়ে হেঁটে চলে এলো। ব্যাকগ্রাউন্ড টা জানতে পারি কি? আর তাছাড়া মনে হচ্ছে আপনারা পূর্ব পরিচিত ।
–আর বোলো না। একটু হেসে বলে রহমত। তোমার বয়সী একটি ছেলে বিয়ের রাতে নববধূকে ইমপ্রেস করার জন্য বলেছিল, তুমি যদি আমায় একটু ভালোবাসো তাতেই আমি খুশি কারণ সামথিং ইজ বেটার দেন নাথিং মানে শামসুদ্দিন তোমার ব্যাটার ঘরের নাতি ।
ঘরে হাসির রোল উঠলো। হাসতে হাসতে ছেলেটি বলল,
–কি আশ্চর্য! মা তো আমার ছেলেটার নামও রেখেছে শামসুদ্দীন ।
বিষম গেলো রহমত। কাপ থেকে ছলকে পড়লো কফি।হেচকির দমকে চোখ ফেটে জল এলো। ছেলেটা দৌড়ে গেল পানি আনতে। বিষমের ধাক্কায় দুফাঁক হয়ে খুলে গেল মনের বদ্ধ কপাট। রাহেলা আবারও কাঁদছে।
সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সন্ধ্যায় ফিরতি ফ্লাইট । তিরিশ বছর আগের মত সব ফেলে আজও রহমতকে পালাতে হবে অসীম শূন্যতার গন্তব্যে।