19.5 C
Düsseldorf

জার্মান জীবণ

Must read

বাংলাদেশ থেকে জার্মানি, এই যাত্রা সহজ ছিলনা। সেই কথা অন্য কোনদিন বলবো। আজকে অন্য কিছু বলি। প্রথমবার জার্মানি এসেছিলাম বেড়াতে ছিলাম ১মাস, তবে এখন জার্মানি হচ্ছে আমার নতুন বাড়ি। এখানে আসার পরে সময়ের সাথে সাথে জানলাম প্রতিদিনের জীবনযাত্রা এখানে কতোটা অন্যরকম। নিয়ম কানুন এইখানে ১০০% মেনে চলতে হবে আর সময় জ্ঞান যদি না থাকে তাহলে আপনি পুরোটাই ধরা। এইরকম আরও অনেক কিছু আছে যা মাথায় রেখে এইখানে চলতেই হবে। বাংলাদেশের থেকে অনেক পার্থক্য এখানে সব কিছুতেই। কিছু সাধারণ পার্থক্য যা আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করেছি তাই আজ বলি।

সময় এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট
জার্মানে সময় খুবি গুরুত্বপূর্ণ। সব কিছু সময় মত এবং সঠিক ভাবে করার ব্যাপারে এরা খুবি সচেতন। এখানে Walk in service বলতে কিছু নাই। যে কোন কাজের জন্য আপনাকে অবশই আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যেতে হবে। এখানে বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্যে, কখনো কখনো ফোন এ কথা বলার জন্যেও শিডিউল করে নিতে হয়। কোথাও যেতে সামান্যতম দেরি হলে, সেটা যার কাছে যাচ্ছেন তাকে জানানো এক ধরনের ভদ্রতা এবং এটা আপনাকে বজায় রাখতেই হবে। একি ভাবে কোন অফিসিয়াল কাজেও যদি আপনি না যেতে পারেন তাহলে আপনাকে আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট টি বাতিল করতে হবে নয়তো ধরে নেয়া হবে আপনি আপনার বন্ধু অথবা অফিস কর্তৃপক্ষের সময় কে সম্মান বা গুরুত্ব দেখাচ্ছেন না।

ভাষাগত জতিলতা
এখানে দোকান, অফিস, শপিংমল কোথায়ও কেউ ইংরেজি ভাষা বলেনা। সুতরাং প্রথম ধাক্কা টা আপনি এখানেই খাবেন। সবজি কেনা থেকে শুরু করে পথ হারিয়ে ফেলার পরে কারো সাহায্য চাইতেও পারবেন না যদি জার্মান ভাষা জানা না থাকে। সরকারি কোন অফিসে গেলেও একি সমস্যায় পরতে হবে। তাই এই দেশে থিতু হবার আগে এখানকার ভাষা শেখার বিকল্প কিছুই নাই।

পরিবহন ব্যাবস্থা
আমরা জ্যাম আর হর্ন এর শব্দে অভ্যস্ত মানুষ। পাবলিক বাস এ ধাক্কাধাক্কি করে অফিস যাই রোজ আমরা। এখানকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। হর্ন বা জ্যাম কদাচিত শুনতে বা দেখতে পাওয়া যায়। কোন বাস বা ট্রেন এ ওঠার জন্য আপনাকে ভিড় ঠেলতে হবেনা। কিন্তু যেটা করতে হবে সেটা হল আপনাকে সময় ঠিক রাখতে হবে। ৫ সেকেন্ড এর জন্য আপনি মিস করতে পারেন বাস অথবা ট্রেন। যদিও এখানে প্রতি ১০ মিনিট অন্তর অন্তর বাস ট্রেন আসে, সুতরাং গন্তব্যে আপনি ঠিকি পৌঁছাবেন কিন্তু হয়ত দেরি হয়ে যাবে। আর জার্মানরা সময়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন আগেই বলেছি। কোথায়ও দেরি করে যাবার কারনে আপনার গুরুত্ব কমে যেতে পারে ১০০ ভাগ। তাই কোথায়ও যাবার আগে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট এর সাথে আপনার বাস বা ট্রেন এর শিডিউলটি মিলিয়ে নেয়াই উত্তম। এখানের পরিবহন ব্যাবস্থার আর একটি সুবিধা হল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট দিয়েই সব জায়গায় যাতায়াত করা যায় এবং সেটা খুব কম সময়ে। কখনো যদি বাস ট্রেন আসতে দেরি হয় তবে কর্তৃপক্ষ আপনাকে সেটা জানাতে দেরি করবে না।

ছুটির দিনে কেনাকাটা
ছুটির দিন শুনলেই মনে হয় কোথায় যাবো, কি করবো, ঘরের কি কি বাজার করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু জার্মানে ছুটির দিন আপনি কিছুই এমন ভেবে সুবিধা করতে পারবেন না। শনিবার, রবিবার এখানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। শনিবার দোকান বা শপিংমল গুলো খোলা থাকলেও কোন রাকমের অফিস এই দিন খোলা থাকেনা। রবিবার এখানে সব কিছু বন্ধ থাকে। আপনাকে যাবতীয় কেনাকাটা সপ্তাহের বাকি ৫ দিন করতে হবে। এমন কি যে কোন পাবলিক হলিডে তেও এইখানে মুদি দোকান পর্যন্ত বন্ধ থাকে। তাই সপ্তাহের বৃহস্পতি এবং শুক্রবার এখানে কেনাকাটার ধুম পরে যায়। এবং এই নিয়মে এরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমার কাছে এই বিষয়টা ব্যাক্তিগত ভাবে ভালো লেগেছে। ছুটির দিন মানি সত্যি ছুটির দিন, আরাম করার দিন, পরিবার নিয়ে আনন্দ করার দিন। যদিও জারুরি প্রয়জনের জন্য মেইন স্টেশন ও এয়ারপোর্ট এর ভিতরের দোকান গুলো খোলা থাকে রবিবার এবং অন্যান্য ছুটির দিন গুলোতেও।

খাবার এবং পানীয়
খাবার এর ব্যাপারটা সাধারনত যার যার রুচির উপরে নির্ভর করে। তবে কিছু জার্মান রেসিপি আছে যেগুলো আসলেই খুবি মজাদার। এদের এত ধরনের ব্রেড আছে যা স্বাদে খুবি ভালো এবং ব্রেড এর এতো ভ্যারাইটি আমার ধরনা আর কোথায়ও নাই। মাংসের বিভিন্ন রকম ম্যানু আর সেই সাথে আলু এবং সালাদ খুবি সুস্বাদু। মাশরুম আর সসেজ এর তো তুলনা হয়না। প্রথম দিকে একটু কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে আপনি এর স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। আর একেবারেই যদি না পারেন তাহলে বাজার করে নিজের মত রান্না করে নেয়া ছাড়া কোন উপায় তো থাকেনা। তবে আমার মতে জীবন যেখানে যেমন, তেমন ভাবে অভ্যস্ত হওয়াটাই ভালো। এখানে খাবারের দাম তুলনামুলক কম বলেই আমার মনে হয়। অন্তত চড়া দামের কারনে কাউকে না খেয়ে থাকতে হয় না । এবং খাবার গুলো স্বাস্থ্যসম্মত এবং ভেজালহীন। অ্যালকোহল এর দেশ জার্মান, বিয়ার অথবা ওয়াইন এর জন্য বিখ্যাত এরা। সকালের নাস্তা টা এক কাপ গরম কফি আর ব্রেড দিয়ে শুরু করতেই আমার ভালো লাগে। এখানে লাঞ্চ অথবা ডিনার এর জন্য ১০ থেকে ১২ ইউরো যথেষ্ট। সকালের নাস্তা ৫ ইউরো তে শেষ করা সম্ভব। আর এক বোতল ওয়াইন কিনতে লাগে ৫ ইউরো থেকেও কম।

অ্যাক্টিভ লাইফস্টাইল
এইখানে আমার সবচেয়ে অবাক লাগে এইটা দেখে যে জার্মানরা কি পরিমাণ একটিভ। সত্যি বলতে যখন আমি নিজেকে দেখি এবং জার্মান দের দেখি তখন আমি হতাশ হয়ে যাই নিজেকে দেখে। পার্কে গেলে দেখা যায় যে এরা কিছু না কিছু অবশ্যই করছে। হয়ত দৌড়াচ্ছে, বল খেলছে, জগিং করছে, ফ্রিসবি খেলছে অথবা সাইকেলিং করছে। মোট কথা কিছু না কিছু করছে। স্পোর্টস করতে এরা খুব ভালবাসে। কম দূরত্বের যায়গা গুলো এরা হেটে যেতে অথবা সাইকেলে যেতেই পছন্দ করে। এবং এইজন্যই জার্মান রা শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকে বৃদ্ধ হবার পরেও। এখানে স্পোর্টস জীবনের একটা প্রয়োজনীয় অংশ। এখানে জিম আছে যেখানে আপনি চাইলেই যোগ দিতে পারেন। এর জন্য প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ ইউরো খরচ হবে আপনার। জার্মানি তে স্পোর্টস কোন বিলাসিতা নয় বরং সুস্থ থাকার জন্য একটি জরুরি প্রয়োজন।

সবুজ আর সবুজ
আমি এসেছি ইট পাঁথর আর মানুষে ঠাঁসা এক শহর থেকে। এখানে এসে আমি এতো সবুজ দেখে রোজ মুগ্ধ হই। এতো এতো পার্ক এখানে আর এতো এতো গাছ যে মন সবসময় শান্ত থাকে। আপনি যেখানেই থাকেন না কেন আপনার নাগালের ভিতরে অবশ্যই একটি পার্ক আছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। যখন কিছুই ভালো লাগেনা অথবা প্রিয়জনদের কথা মনে হয় তাখন একটু সবুজের কাছে গেলে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।

আবহাওয়া
সত্যি কথা বললে আমাদের দেশের মতো ঋতু বৈচিত্র্য নাই এখানে। শীত প্রধান দেশ। এখানে আসলে আপনাকে মানুষিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে পুরোপুরি বিপরিত এই আবহাওয়ায় নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য। প্রথম দিকে কষ্ট হলেও পরে সময়ের সাথে সব ঠিক হতে থাকে।

উপসংহার
বলতে দ্বিধা নেই। জার্মানি আসার পর আমার জীবনের চেনা জানা দুনিয়াটা পালটে যেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে যেমন ২৫শে বুড়ী হয়ে যেতে হয়, সেটা কিন্তু এখানে নয়। ৫০ বছর পর্যন্ত জার্মানরা নিজেদের তরুন বা যুবক মনে করে। সত্যিটা হলো এদের কাছে বয়স কোন ব্যাপার না। বাংলাদেশের অনেক কিছু যেমন খুব মিস করছি, তেমনি আমার নতুন দেশকেও বেশ উপভোগ করছি। দেশ থেকে না বের হলে হয়ত অনেক কিছু জানা হত না। তাই চেষ্টা করুন যত বেশী দেশ বিদেশ ঘোরা যায়। দেখবেন মনের জানালা কিভাবে প্রসারিত হতে শুরু করে।

- Advertisement -spot_img

More articles

মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে অনুগ্রহ করে আপনার নাম লিখুন

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ আপডেট