জার্মানি থেকে ডিপোর্টেশন বা দেশে প্রত্যর্পণের নিয়ম

Must read

গোলজার হোসাইন খান
আমি সোনালী ব্যাংক লিমিটেড এর একজন অবসরপ্রাপ্ত এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার।অতি সাধারণ মানুষ। কোন উচ্চাভিলাষ নেই। সাংসারিক বোধবুদ্ধি শূন্যের কোঠায়। হেরে যাওয়া মানুষের পাশে থাকি।এড়িয়ে চলি স্বার্থপরতা।বিনম্র শ্রদ্ধায় নত হই সৃষ্টিশীল-পরিশ্রমী মানুষের প্রতি আর ভালবাসি আমার পেশাকে।

২০১২ সাল থেকেই নিয়ম করে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে সিরিয়ান নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা৷ কারণ, জার্মানি থেকে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সিরিয়ায় জোর করে ফেরত পাঠানো হলে, শরণার্থীদের জীবনের ঝুঁকি থাকতে পারে৷
ফেরত পাঠানো যাবে না রাজনৈতিক আশ্রয় না পাওয়া ব্যক্তি, এমনকি অপরাধীরাও৷ জার্মানিতে থাকতে দিতে হবে তাদেরও, কারণ সিরিয়ায় ফিরে গেলে তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারবে না জার্মানি, বলে মত সমালোচকদের একাংশের৷

কিন্তু ২০২০ সালের একটি বৈঠকের পর, জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হর্স্ট জেহোফার জানান যে, ব্যক্তিবিশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো যাবে সিরিয়ান নাগরিকের৷

যে সব রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, তাদের দেশে থাকতে দেওয়া বিষয়ে জার্মানির সহনশীলতা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷ বিশেষ করে, মুসলিম বিশ্বের দেশ থেকে আসা যে সকল রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে রয়েছে অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ, তাদের প্রতি সরকারের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জার্মানির ডানপন্থি সংগঠনগুলি৷

তাদের এই দাবি জোরদার হয় যখন ড্রেসডেনে এক সিরিয়ান যুবকের ছুরিকাঘাতে একজন আহত ও একজন নিহত হওয়ার ঘটনা উঠে আসে৷ বিচারকরা জানান সেই যুবকের বিরুদ্ধে অন্যান্য আরো অপরাধের পাশাপাশি অভিযোগ ছিল ইসলামিস্টদের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগও৷ জানা যায় যে, বেশ কিছু দিন ধরেই পুলিশের নজরে ছিল সে৷ তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হয়ে গেলেও জার্মানিতে ‘টলারেটেড’ বা ‘আপাতদৃষ্টিতে সহনীয়’ হিসাবে থাকার অনুমতি পায় সে৷

২০১১ সাল থেকে চলে আসা বহুুমুখী গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়ায় গৃহহীন হয়ে পড়েন লাখ লাখ মানুষ, প্রাণ হারান তিন লাখ ৮৭ হাজার মানুষ৷ এই যু্দ্ধের ভয়াবহতার কারণেই এই যুবক ও তার মতো আরো অনেকে জার্মানিতে থেকে যাবার সুযোগ পায়৷
জার্মানির অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হান্স-গিওর্গ এঙ্গেলকে বলেন, ‘‘যারা অপরাধ করেন বা সন্ত্রাসী লক্ষ্যে কাজ করে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে গভীরভাবে আহত করতে চায়, তাদের দেশ ছেড়ে যেতেই হবে৷’’

যুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে জার্মানিতে এসে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সাত লাখ ৭০ হাজার সিরিয়ান নাগরিকের মধ্যে আনুমানিক ৯০জনকে জার্মানির জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়৷ এমন ব্যক্তিদের দেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা প্রবল৷

করোনা সংকটের কারণে বিদেশযাত্রায় বিধিনিষেধ আরোপ করা ছাড়া পদ্ধতিগত নানা জটিলতার কারণে সিরিয়ায় মানুষদের ফেরত পাঠানোর কাজ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে৷ জার্মানির নিডারজাক্সেন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস বলেন, ‘‘সিরিয়ার কোনো আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আমাদের কূটনৈতিক চুক্তি নেই৷’’

পিস্টোরিয়াস ও তাঁর দল, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, সিরিয়ানদের ফেরত পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়ার বিরোধিতা করে আসছিলেন বহুদিন ধরে৷ কিন্তু, এই নিষেধাজ্ঞাকে আরো ছয়মাসে জন্য দীর্ঘায়িত করতে রাজি করতে পারেননি কর্তৃপক্ষকে।

জার্মান কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে ২২ হাজারের বেশি সিরিয়ানদের দেশে ফেরত পাঠিয়েছে সরকার৷ ২০১৬ সালেই এই সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার, কিন্তু এরপর থেকে এই সংখ্যা কমেছে৷
২০১৯ সালে ফেরত পাঠানোদের তালিকায় প্রথম পাঁচে ছিল আলবেনিয়া, নাইজেরিয়া, সার্বিয়া, রাশিয়া ও জর্জিয়ার নাগরিকরা৷ প্রতিটি দেশের প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়৷ এছাড়া, একই বছর ৯৩০জন আফগান ও ৮৬০ জন ইরাকের নাগরিকদের ফেরত পাঠানো হয়েছে৷

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে, ‘ডিপোর্টেশন’ মানেই সব সময় কোনো ব্যক্তির নিজের দেশে ফেরত পাঠানো নয়৷ প্রয়োজনবিশেষে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্য কোনো দেশেও স্থানাস্তরিত করা হতে পারে৷ ২০১৯ সালে মোট ডিপোর্টেশন সংখ্যার ৪০ শতাংশকেই পাঠানো হয় ফ্রান্স বা ইটালির মতো কোনো তৃতীয় ইউরোপীয় দেশে, জানাচ্ছে জার্মানির নাগরিক শিক্ষা বিভাগ বা বিপিবি৷
যে দেশে যুদ্ধ বা অত্যাচারের সম্ভাবনার কারণে কোনো ব্যক্তির জীবনের ঝুঁকি থাকতে পারে, তেমন কাউকে জার্মানি থেকে কোনো দেশে ফেরত পাঠানো যাবেনা ৷ এমনটা না মানা হলে তা ইউরোপিয়ান মানবাধিকার কনভেনশনের বিরোধী হবে, যা কোনো ব্যক্তিকে অত্যাচারের মুখে ঠেলে দেওয়ার সমান৷
প্রত্যর্পণ হবে কি না এবং তা হলেও কীভাবে হবে, তা নির্ণয় করার পেছনে থাকে নানা কারণ৷ অভিবাসীরা তাদের আইনজীবীদের সাহায্য নিয়ে এমন প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন৷ এই প্রক্রিয়া আদালত ঘুরে আসতেও লাগে বেশ খানিকটা সময়৷

প্রত্যাখ্যাত আবেদনগুলি পরে আবার একটি ‘হার্ডশিপ কমিশন’ বিবেচনা করতে পারে, যারা জার্মান কর্তৃপক্ষকে প্রত্যর্পণ ঠেকাতে সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ক্ষমতা রয়েছে এই সুপারিশ খারিজ করে ডিপোর্টেশনের রায় বহাল রাখা৷
ভ্রমণ বা পরিচয়পত্রের নথি না থাকা সাধারণত কর্তৃপক্ষের কাজে বাধা হয়ে ওঠে, কারণ দেশে ফেরত পাঠানোর আগে ব্যক্তিদের পরিচয় যাচাই করা কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক দায়িত্ব হিসাবে থাকে৷ এছাড়া, অভিবাসীদের মূল দেশটিও প্রক্রিয়ায় দেরি করে বা কখনো কখনো নাগরিকদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে৷

প্রত্যর্পণ ঠেকানোর শেষ পন্থা শারীরিক প্রতিরোধ৷ কিছু ক্ষেত্রে, বিমানকর্মীরা কোনো যাত্রীকে বিমানে তুলতে অস্বীকার করেছেন, অন্যান্য যাত্রীদের ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে৷ অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কর্মীরা অবশ্য এমন আচরণকে কিছুটা অপছন্দ করেন ও ঝামেলা এড়াতে ডিপোর্টেশনের তারিখ পিছিয়ে দেয়৷

কিন্তু নিজের দেশে প্রত্যর্পণই একজন অভিবাসনপ্রত্যাশীর জন্য শেষ কথা নয়৷ জার্মানি থেকে বের করে দেওয়া হলেও এক ব্যক্তির অধিকার রয়েছে পুনরায় জার্মানিতে এসে আশ্রয়ের আবেদন করার৷

- Advertisement -

মন্তব্য করুন

অনুগ্রহ করে আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে অনুগ্রহ করে আপনার নাম লিখুন

Exit mobile version