বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় এক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন৷ তবে যতই বিরোধ থাকুক, জলবায়ু পরিবর্তন, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো কিছু বিষয়ে দুই পক্ষেরই একে অপরকে প্রয়োজন৷
এই দুয়ের মধ্যে কী করে ভারসাম্য আনা যায়, তার সমাধান খোঁজা হয়েছে মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদনে৷
সদ্য প্রকাশিত মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদনকে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি সুযোগ হিসেবেই বিবেচনা করা যায়৷ এটি এমন এক সময় প্রকাশ হয়েছে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউরোপে তার প্রথম সফরে আসছেন, ইংল্যান্ডে জি সেভেন সম্মেলন, এরপর ব্রাসেলসে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক দেশগুলোর অংশগ্রহণে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিবেন তিনি৷ তারপরে জেনেভাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের সঙ্গেও বৈঠক করবেন বাইডেন৷
এমন প্রেক্ষাপটেই মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের সবশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে যার শিরোনাম, ‘বিটুইন স্টেটস অব ম্যাটার-কমপিটিশন অ্যান্ড কোঅপারেশন’ (রাষ্ট্রের মধ্যকার সমস্যা-প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা)৷
শিরোনামটি ১৬০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের সারমর্ম তুলে ধরেছে: পশ্চিমা গণতন্ত্র চ্যালেঞ্জের মুখে, বিশেষ করে চীনের কারণে৷ একইসঙ্গে দুই পক্ষেরই একে অপরকে দরকার, শুধু যে ব্যবসার জন্য তা নয়, বরং বর্তমান বিশ্বের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্যও৷
সহযোগিতার সম্পর্ক কোথায় দরকার তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ কোভিড-১৯ মহামারি৷ একই কথা বলা চলে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গেও৷ চীনের সঙ্গে পরস্পরবিরোধী এই সম্পর্কের একদিকে রয়েছে প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে ইইউ এর জন্য কৌশলগত অংশীদারিত্ব৷
একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যা পারেনি, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বেইজিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি তা করে দেখিয়েছে৷ কর্তৃত্ববাদী শাসনের পরও তারা অর্থনৈতিক সাফল্য আর জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারছে৷ যেকারণেই হয়ত বাইডেন তার একাধিক বক্তব্যে এমন কথা বলেছেন, ‘‘পরিবর্তনশীল বিশ্বে গণতন্ত্র এখনও আমাদের জনগণের জন্য ভূমিকা রেখে চলছে, যা আমাদের অবশ্যই তুলে ধরতে হবে৷’’
১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ চার যুগ ধরে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার পাশাপাশি কিভাবে তার অর্থনৈতিক শক্তিকে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারে তার উদাহরণ চীন৷ এক্ষেত্রে দেশটি নিজেই নিজের জন্য উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷ ২০৪৯ সালের মধ্যে পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার ১০০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগে দেশটি একটি পরিপূর্ণ উন্নত, আধুনিক ও সামাজিক শক্তিতে পরিণত হতে চায়৷ সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতির দিক থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায় শিখরে৷ অর্থাৎ, চীন নিজেদের বৈশ্বিক শক্তিকে সৃদৃঢ় করতে চায়৷
মিউনিখ নিরাপত্তা প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলো এখন অনুদার প্রতিযোগীদের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে চায়৷ মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের নীতি ও বিশ্লেষণ প্রধান এবং এ বছরের প্রতিবেদনের অন্যতম রচয়িতা টবিয়াস বুন্ডে বাইডেনকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘‘ট্রান্সআটলান্টিক নেতারা একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে চাইছেন যার মাধ্যমে বিশ্বের প্রধান গণতান্ত্রিক দেশগুলো একই ধরনের হুমকিগুলোর বিপরীতে নিজেদের শক্তিশালী করতে পারে৷ প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেমন বলেছেন: আমরা সত্যিই এক বাঁকবদলের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি এবং এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের গণতন্ত্রগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে৷’’
প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে টিকে থাকা পশ্চিমের এতদিনকার ‘আদর্শগত আধিপত্য’ যে প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে সেটিকে তাদের জন্য অন্যতম হুমকি বলে মনে করছেন বুন্ডে৷ তার মতে, ‘‘কয়েক বছর আগেও আমরা আরটিপি (‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ বা রক্ষার দায়িত্ব) তত্ত্ব এবং আরবে মানবাধিকারের চূড়ান্ত বিজয় নিয়ে আলোচনা করতাম৷ এখন বেইজিং সহজে শিনজিয়াং ও হংকং প্রসঙ্গে কয়েক ডজন দেশকে প্রভাবিত করতে পারছে৷’’
চলতি বছরের প্রতিবেদনে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূমিকাকে আলোচনার কেন্দ্রে রাখা হয়েছে৷ বিশ্ব অর্থনীতির ৬০ শতাংশ উৎপাদন ও দুই-তৃতীয়াংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যোগান দেয় এই অঞ্চল৷ তবে প্রতিবেদনে গুরুত্ব পাওয়া শুধু এ কারণে নয়৷
প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের উপর গভীর দৃষ্টিপাত করা হয়েছে ‘‘তার কারণ অনেকেই এখন একমত যে এটি এমন এক অঞ্চল যেখানে শুধু স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নয়, বরং আসছে দশকগুলোতে যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন কাঠামো নির্ধারণ হতে যাচ্ছে,’’ এমনটাই বলেছেন প্রতিবেদনের সহ-রচয়িতা সোফি আইসেনট্রাউট৷
এই উপলব্ধির প্রতফলন এরই মধ্যে বাস্তব রাজনীতিতেও পড়েছে৷ জুনের শুরুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল ইন্দোনেশিয়া সফরে গিয়ে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷
মে মাসের শেষ দিকে জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনেগরেট ক্রাম্প-কারেনবাওয়ার প্রশান্ত মহাসাগরে জার্মান সৈন্য নিযুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা করতে দক্ষিণ কোরিয়া সফরে গেছেন৷ একই সফরে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি গুয়াম দ্বীপেও যান৷
প্রতিবেদনের রচয়িতারা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাকে বিশ্বের অন্য অংশের সমমনা অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক সংহত করার পরামর্শ দিয়েছেন৷ তারা লিখেছেন, গণতান্ত্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্র আরো বিশদভাবে প্রসারিত হলেই, দেশগুলো স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপক্ষে প্রতিযোগিতা করতে পারবে৷
কিন্তু এজন্য ইউরোপীয় দেশগুলোকে শুরুতে এককাট্টা হতে হবে, মনে করেন মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের চেয়ারম্যান ওলফগাং ইশিনগার৷
-ডয়েচে ভেলে