গোয়েব্লস। জার্মানির ইতিহাসে বহুল আলোচিত নাম।ছিলেন হিটলারের মিনিস্ট্রি অব প্রপাগান্ডার প্রধান।তিনি চাইতেন রেডিওর মাধ্যমে মতাদর্শকে প্রতিটি ঘরে ঘরে শ্রবণের মাধ্যমে মস্তিষ্কে গেঁথে ও পুঁতে দিতে। সেই মতাদর্শ ছিল সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী, ঘৃণার বেসাতির, এবং স্তূপাকার মিথ্যের সারির। সরকারি রেডিওতে তাই শোনা যেত যা গোয়েব্লস নিজে চাইতেন।
সেইসময় প্রচারিত হচ্ছিল মূলত কয়েকটি তত্ত্ব। জার্মান জাতি অবিসংবাদী, একমাত্র তাঁদের যোগ্যতা আর অধিকার আছে সারা পৃথিবী জয় এবং শাসন করার। জার্মান জাতি শ্রেষ্ঠ জাতি, ইহুদি’রা নরকের দূত, অতএব নির্বিচারে তাঁদের হত্যার মধ্যে কোনও ভুল বা পাপ নেই। নাজি দলই একমাত্র ভিত্তি এবং ভবিষ্যৎ। বিকল্প বলে কিছুই নেই, ছিল না, থাকবেও না। কম্যুনিস্টরা ভ্রান্ত ধারণার গোলকধাঁধা’য় ফেলে জাতিগৌরব ক্ষুণ্ণ করতে চায়। অতএব দেশ থেকে তাঁদের মুছে দেওয়া খুবই ন্যায়সঙ্গত এবং জরুরি।
সেই সময় জার্মানি’র সংবাদপত্রে তাই ছাপানো হতো যা তিনি চাইতেন। অতিরঞ্জিত জার্মান বাহিনীর বীরগাথা হিসেবে প্রদর্শন করতেন। সে সময় যুদ্ধের যাবতীয় খবর আসত তাঁর অফিস থেকে। বিরোধীদলের পক্ষে বা নিরপেক্ষ কথা বলে, খবর করে, এমন সংবাদপত্রগুলো একের পর এক বন্ধ করে তাদের প্রচার-প্রকাশনাও সরকারি নজরদারির আওতায় আনা হয়েছিল।
এই ছিল গোয়েব্লসের মারাত্মক ‘প্রোপাগান্ডা’।উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার বিস্ফোরণ।একটা মিথ্যে বলো এবং ততক্ষণ বলো যতক্ষণ না সেটা সত্যিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বলো, মিথ্যে-মিথ্যে-মিথ্যে, এই শুনতে শুনতে জনগণের কাছে সত্যের নামান্তর মনে হতে পারে, মনে হবে সত্যি, সত্যিই, এই সত্যি অবশ্যই। এইভাবে গোয়েব্লস মিথ্যেকে সত্যি বানানোর কারখানা খুলেছিলেন। বিপুল বাজনা বাদ্যির মধ্যে সাধারণ মানুষের পক্ষে খুঁজে বের করা অসম্ভব হত, ফারাক করা অসম্ভব হত সত্যি মিথ্যে’র সীমারেখা।
১৯৩৩, বার্লিন অপেরা হাউস-এর একটি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে জার্মান লেখক এবং বুদ্ধিজীবীদের যে সমস্ত বই জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেনা, অ-জার্মান বা ইহুদিদের ভালো কাজের কথা বলে, প্রচার করেনা নাজি দলের অবিসংবাদীত শ্রেষ্ঠ ভূমিকার কথা সেসব জনসমক্ষে পোড়ানোর বহ্নুৎসব শুরুর ঘোষণা দেন। সেই উৎসব শুরু হয়েছিল, এখান থেকেই। বিজয়ীর হাসি হেসে সেদিন গোয়েবেলস জনগণের উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছিলেন, ‘চরম ইহুদী বৌদ্ধিকতার যুগের অবসান ঘটল’।
জার্মানিতে জন্মানো জগৎবিখ্যাত ইহুদি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, ইহুদি মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড অথবা জার্মান বংশোদ্ভূত লেখকদের গুচ্ছ গুচ্ছ কাজ নিমেষে ধ্বংস করে দেওয়া হতে থাকে, তাঁর নির্দেশে। নিজেকে তিনি জার্মান চলচ্চিত্রের অভিভাবক নিরূপিত করেছিলেন। চলমান চিত্রমালার শব্দ ও ছবিকে কাজে লাগিয়ে জার্মানদের মধ্যে নাজিপন্থার বীজ আরও আরও গভীরে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত করেন। ইহুদিমাত্রই বিশ্বকে ব্যাহত করছে, ইহুদি মাত্রেই পরজীবী এই ছিল সার কথা।
আশ্চর্যের কথা এই যে গোয়েব্লস এর কৈশোরের সমস্ত প্রিয় শিক্ষকরা ছিলেন ইহুদি, এমনকি তাঁর প্রথম প্রেমিকাও ছিলেন ইহুদি বংশদ্ভুত। সেইসময় শোরগোল ওঠে ইহুদি-বিদ্বেষী গোয়েব্লস খাঁটি নীল রক্তের জার্মান নন, তাঁর বংশ তালিকায় ইহুদি ছাপ রয়েছে। বিতর্ক গড়ালে গোয়েব্লস নিজের বংশতালিকা জনসমক্ষে আনেন, এবং নানা মাধ্যমে প্রচার করেন।
তার অসাধারণ বাগ্মিতা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো।তার বহুল ব্যবহৃত কথা গুলো নিম্নরূপঃ
“আপনি যদি একটি বিশাল মিথ্যা বলেন এবং সেটা পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন, তাহলে মানুষজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবে।”
“সংবাদমাধ্যমকে একটি বিশাল কীবোর্ড হিসেবে চিন্তা করুন যার উপর সরকার ইচ্ছামতো বাজাতে পারে।”
“আমরা ইতিহাসে ঠাই পাবো হয় সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র অধিনায়ক অথবা সর্বশ্রেষ্ঠ অপরাধী হিসেবে।”
“সত্য রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ শত্রু ।”
এই যে এতো এতো মিথ্যার বেসাতি করলেন।কিন্তু নিজের জীবনের নির্মম সত্যিটা হয়তো জানা ছিল না তার।তাই জার্মানদের পরাজয়ের শেষ মূহুর্তে নিজের ছয়জন শিশু সন্তান সহ স্ত্রীকে হত্যা করে নিজেও আত্মঘাতি হন এই “গোয়েবলসতত্ত্বের’ জনক।