শুরু থেকেই শুরু করা যাক। ইউরোপের শীর্ষ দুই দলের বাঁচা মরার লড়াই। পা হড়কালেই বাড়ি ফেরার টিকিট, জিতলে আরো একবার লড়াইয়ে নামার সুযোগ। এমন ম্যাচে জানবাজি রেখে লড়বে যে কেউই। হচ্ছিলোও তাই। দু’পক্ষই লড়ছিলো সমানতালে, চলছিলো আক্রমন-পাল্টা আক্রমন।এরই মাঝে সোমবার রাতেই ইউরো ২০২০ এর সেরা গোল সম্ভবত দেখে ফেলেছে ফুটবল বিশ্ব। নেপথ্যে পল পগবা। ৭৫ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে ডান পায়ের বাঁক খাওয়ানো শটে পগবা যে ভাবে গোল পোস্টের কোণ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দিল, তা অবিশ্বাস্য। এ রকম গোল দেখার জন্য রাত জাগতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু জয় হাতছাড়া হয়ে গেল ২০১৮ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নদের। টাইব্রেকারে সুইজ়ারল্যান্ডের কাছে হেরে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিল ফ্রান্স।
বুখারেস্টে সোমবার ইউরো ২০২০-র শেষ ষোলোর ম্যাচে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সুইজ়ারল্যান্ডকে কোনও বিশেষজ্ঞই এগিয়ে রেখেছিলেন বলে মনে হয় না। সকলেরই ধারণা ছিল, সুইসদের দাঁড়াতেই দেবে না ২০১৮ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নরা।
কিন্তু ফুটবল যে চরম অনিশ্চয়তার খেলা, আবারও প্রমাণিত হল। ম্যাচের ১৫ মিনিটেই হ্যারিস সেফেরোভিচের দুরন্ত গোলে সকলকে স্তম্ভিত করে এগিয়ে যায় সুইজ়ারল্যান্ড। বাঁ-দিকে পেনাল্টি বক্সের ঠিক বাইরে থেকে সেন্টার করেছিল স্টিভন জ়ুবের। নিখুঁত হেডে গোলরক্ষকের ডান দিক দিয়ে হ্যারিস বল জালে জড়িয়ে দেয়। কিছু করার ছিল না হুগো লরিসের। দারুণ গোল!
কিন্তু অবাক হতে হয়েছে ফ্রান্সের খেলা দেখে। গ্রুপ পর্ব থেকে তৃতীয় হয়ে কোনও মতে শেষ ষোলোয় যোগ্যতা অর্জন করা সুইসদের কি হাল্কা ভাবে নিয়েছিলেন দিদিয়ের দেশম? প্রশ্নটা উঠছে কারণ, এই ম্যাচে তিনি দল সাজিয়েছিলেন ৩-৪-১-২ ছকে। ফরাসি কোচ হয়তো ভেবেছিলেন, সুইজ়ারল্যান্ডের আক্রমণভাগ সামলানোর জন্য তিন জন ডিফেন্ডারই যথেষ্ট। তিন ডিফেন্ডারে খেলা খুব কঠিন। মাঝখানে যে স্টপার থাকে, সে একা পড়ে যায়। এই কারণে সহজেই কেমন লংলের মাথার উপর দিয়ে হেড করে গোল করতে পেরেছিল সেফেরোভিচ। অসাধারণ খেলল জ়ার্দান শাকিরিরা। মনে হচ্ছিল, এই ছকে লংলে মানিয়ে নিয়ে পারছে না। ওকে মাঠে রাখাটা ঝুঁকির।
হঠাৎ রণকৌশল বদলে ফেললে সমস্যা হবেই। প্রভাব পড়ে খেলায়। ঠিক সেটাই হয়েছিল প্রথমার্ধে। কিলিয়ান এমবাপে, আঁতোয়া গ্রিজ়ম্যান, পল পগবাকে অনেক নিষ্প্রভ দেখিয়েছে প্রথমার্ধে। করিম বেঞ্জেমাও গোল করার বল পাচ্ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দু’টি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নেন দেশম। প্রথমত লংলের পরিবর্তে কিংসলে কোমানকে নামান আর রণকৌশলে সামান্য পরিবর্তন করেন। রক্ষণের শক্তি বাড়াতে আদ্রিয়ান হাবিউ-কে একটু নীচে নামিয়ে আনেন। তা সত্ত্বেও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল সুইজ়ারল্যান্ড। ৫৩ মিনিটে জ়ুবেরকে ফাউল করলে পেনাল্টি থেকে নেওয়া রিকার্দো রদ্রিগেসের শট অসাধারণ দক্ষতায় ডান দিকে ঝাঁপিয়ে বাঁচায় হুগো। এরপরেই দুর্দান্ত ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় ফ্রান্স। ৫৭ মিনিটে এমবাপের পাস থেকে গোল করে ১-১ এ সমতা আনে বেঞ্জেমা। দু’মিনিটের মধ্যে ফের গোল করে রিয়াল মাদ্রিদ স্ট্রাইকার। এ বারও পাস দিয়েছিল এমবাপে। সেই সঙ্গে বেঞ্জেমা স্পর্শ করল জ়িনেদিন জ়িদানের নজিরও। ফ্রান্সের হয়ে দু’জনেরই গোল সংখ্যা এখন ৩১। পগবা ৩-১ করে ৭৫ মিনিটে। ৮১ মিনিটে ফের হ্যারিস গোল করে ব্যবধান কমায়। ৯০ মিনিটে নাটকীয় ভাবে ৩-৩ করে মারিয়ো গাভরানোভিচ। ফ্রান্স রক্ষণের ভুলেই। সংযুক্ত সময়ে কোমানের শট পোস্টে লাগে। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
সোমবার সন্ধ্যায় ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে স্পেনের ৫-৩ রুদ্ধশ্বাস জয় দেখেছে সবাই। ভাবাই যায়নি ফ্রান্স বনাম সুইজ়ারল্যান্ড ম্যাচও এত রোমাঞ্চকর হবে। অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই ধাক্কা খায় ফ্রান্স। চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ে বেঞ্জেমা। তার পরিবর্তে নামে অলিভিয়ের জিহু। তার আগেই গ্রিজ়ম্যানকে তুলে মুসা সিসোক্ককে নামিয়েছিলেন দেশম। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে চোট পয়ে উঠে যায় কোমানও। তার পরেও একাধিক সুযোগ পেয়েছিল ফ্রান্স। ১১৯ মিনিটে জিহুর হেড অবিশ্বাস্য দক্ষতায় শরীর শূন্য ছুড়ে বাঁচায় সুইজ়ারল্যান্ডের গোলরক্ষক ইয়ান সোমের।
শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে এমবাপের শট আটকে দেয় ইয়ান সোমের। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের যোগ্য দল হিসেবেই হারাল সুইসরা। শেষ আটে তাদের প্রতিপক্ষ স্পেন।
ইংল্যান্ড জার্মানি মহারণ আজ
ইউরোর ফাইনালের দিন এখনো দূরে। তার আগেই অলিখিত ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে জার্মানি এবং ইংল্যান্ড। এই দুই দেশের ফুটবল লড়াই মহারণে পরিণত হতে যাচ্ছে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম।
এই দুই দল মাঠে নামার আগেই তির ছোড়া শুরু হয়ে গেছে। এ যেন মাঠে নামার আগেই স্টেডিয়ামের বাইরে মারামারি। লন্ডনের ওয়েম্বলিতে জার্মানিকে অনুশীলন করতে দেওয়া হবে না। আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিয়ম হচ্ছে ম্যাচের আগের দিন দুই দলই অনুশীলন করার সুযোগ পাবে। কিন্তু উয়েফা জানিয়ে দিয়েছে জার্মানি ওয়েম্বলিতে অনুশীলন করতে পারবে না। কারণ বৃষ্টি। বৃষ্টিভেজা মাঠে অনুশীলন করতে দেওয়া যায় না। এই কথা বলে জার্মানিকে ঠেকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এমন খবরে মহা খেপেছেন জার্মান কোচ জোয়াকিম লো। এটা কী ধরনের আচরণ। উয়েফার এমন আচরণে জার্মানিরাও ক্ষুব্ধ। সেখানকার সংবাদপত্রগুলোতে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। আর এসব নিয়ে ম্যাচের চেয়ে ম্যাচের বাইরের আলোচনা বেশিই হচ্ছে ইউরোতে।
উয়েফা বলছে বৃষ্টির কারণে মাচের ২৪ ঘণ্টা আগে অনুশীলন করতে দেওয়া হচ্ছে না। উয়েফা খবর নিয়েছে ম্যাচের ২৪ ঘণ্টা আগে ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। যদি বৃষ্টি হয়, আর সেখানে অনুশীলন করা হয়, তাহলে মাঠ নষ্ট হবে।
নকআউটে জার্মানির বিপক্ষে ইংল্যান্ড কখনো জিতেনি। বরং এই দুই দলের ফুটবল ইতিহাসে রয়েছে অনেক ঘটনা। ফুটবল মাঠের নানা ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে মাঠের শত্রুতা শুরু। যা দেখে ফুটবল দর্শকের চোখেও ফুটবলের বাড়তি উত্তাপে রূপ নেই জার্মানি ইংল্যান্ড ম্যাচ।
যদি ধরা হয় ১৯৬৬ বিশ্বকাপ। সেখানে আরেক ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল। আজকে যে ওয়েম্বলিতে খেলা হবে সেখানে পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। সেটাই ছিল ইংল্যান্ডের শেষ বিশ্বকাপ জয়। ৯৬ ইউরোতে জার্মানির বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করেছিলেন। ২০১০ বিশ্বকাপে হারতে হয়েছিল ইংল্যান্ডকে। হারের সেইসব কিছু মনে রাখতে রাজি না ইংল্যান্ড। সেই দলের জার্সি গায়ে পেনাল্টি মিস করেছিলেন আজকের ইংল্যান্ডের কোচ গেরেথ সাউথগেট। আগের প্রসঙ্গ উঠলে এই কোচ সবকিছু এড়িয়ে যান। বলছিলেন পুরোনো সব কথা টেনে এনে লাভ কী। ইংলিশ সংবাদ মাধ্যমকে সাউথগেট জানিয়েছে এখন যারা ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে খেলছেন তারা সেই সব পুরোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না। বলছেন, ‘এখানকার খেলোয়াড়রা জন্মেছে ২০০০ সালের পর। তাদের কাছে সেই সব কথা আমলে যায় না। সাউগেট যে কথাই বলুন না কেন, ইংলিশরা কখনো অতীত ইতিহাস ভুলে যান না। ভেতরে ভেতরে তারা প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে থাকেন। তবে ইংলিশ কোচ মনে করিয়ে দিয়েছেন তারা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে ভুল করেন না।
জার্মান কোচ জোয়াকিম লো তার শিষ্যদের রাঙিয়ে দিতে, উজ্জীবিত করতে সাফেল্যর কথাগুলো তুলে ধরেছেন। এই কোচ এবার জাতীয় দলের দায়িত্ব ছড়ে দেবেন। তার আগে স্মরণীয় লড়াইটা উপহার চাইছেন নয়ারদের কাছে।