জার্মানির আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনের চাবিকাঠি কি আন্নালেনা বায়েরবকের হাতে? প্রথমবারের মতো কি জার্মানির চ্যান্সেলর হতে চলেছেন গ্রিন পার্টির কোনো নেতা? এমন প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশটির রাজনৈতিক মহলে। রক্ষণশীল এবং মধ্য-বামপন্থী শিবিরের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তুলনা করলে বায়েরবক অনেক বেশি প্রগতিশীল। আপাতদৃষ্টিতে দেশের শীর্ষ কোনো রাজনৈতিক পদে না থাকলেও জার্মানীর ফেডারেল সরকারের শীর্ষ পদটি পেয়ে যেতে পারেন এই নারীই।
জার্মান নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই ডানা মেলছে এই ধারণাটি। প্রচারণার বিশেষত্ব বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাচ্ছে লড়াইটা কোথায়। রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ, সবখানেই আলোচনা- “লড়াইটা একজনের বিপক্ষে দুইজনের”।
আরো নির্দিষ্ট করে বললে, “এক নারীর বিরুদ্ধে দুই পরুষে”র লড়াই। দুই ষাটোর্দ্ধের লড়াই এক চল্লিশোর্দ্ধের বিরুদ্ধে। জার্মানীতে এবার চ্যান্সেলর পদে এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন দুই আইনজীবী। কার্যনির্বাহী কোনো পদে কাজের অভিজ্ঞতা নেই, এমন একজনের প্রতিদ্বন্দ্বী এবার দক্ষ দুই প্রশাসক। যে দুইজন জার্মানির ঐতিহ্যবাহী বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রার্থী। অন্যদিকে ওই একজন প্রার্থীর দল হতে পারে জার্মানির আগামী দিনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি।
গ্রিন পার্টির চ্যান্সেলর প্রার্থী আন্নালেনা বায়েরবক। বর্তমান জোট সরকারের বড় শরিক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) মনোনয়ন দিয়েছে আরমিন লাশেটকে। আর বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর ওলাফ শোলয মনোনয়ন পেয়েছেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এসপিডি) থেকে। বায়েরবকের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে লাশেট ও শোলযের মধ্যকার সাদৃশ্য অবাক করে দেয়ার মতো। একজনের বিরুদ্ধে দুইজন। অথবা নতুনের বিপক্ষে পুরোনো। প্রশ্ন হলো, পুরোনো চেহারাই কি ফিরে আসবে? নাকি সময় এখন নতুনের?
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে মনে হচ্ছে, নতুন অধ্যায়ের শুরু হতে চলেছে জার্মানিতে। দেশটি নিজেই একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। চলমান করোনো অতিমারি সবকিছুকেই গুলিয়ে দিয়েছে। প্রশ্নের মুখে পড়েছে অনেক সমীকরণ। এই সঙ্কট প্রমাণ করে দিয়েছে, কাজ করার অনেক পুরোনো রীতিই এখন অচল।
আগামী সেপ্টেম্বরে যে দেশটি একটি ফেডারেল নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে, সেই জার্মানি চলমান অতিমারিতে অনেকটাই বিপর্যস্ত। খানিকটা অস্থিতিশীলও বটে। আগামী পাঁচ মাসে অতিমারিকে হয়তোবা কাবু করা সম্ভব হবে কিছুটা, কিন্তু জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলা এতটা সহজ হবে না। নির্বাচনের ফল নির্ধারণে এই সঙ্কট প্রভাব ফেলতে পারে প্রবলভাবে।
১৯৪৯ সালের পর এই প্রথম ক্ষমতাসীন কোনো চ্যান্সেলর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। ফলে বিশেষ কোনো সুবিধাপ্রাপ্তিরও সুযোগ নেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের। আঙ্গেলা মের্কেল যুগের অবসান হতে চলেছে। বিদায়ের সময় মের্কেল রেখে যাচ্ছেন অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত রক্ষণশীল একটি শিবির। সিডিইউ এবং বাভারিয়াভিত্তিক ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ)’র যুগপৎ ‘দ্য ইউনিয়ন’ জার্মানির কেন্দ্রক্ষমতায় আছে ২০০৫ সাল থেকে। কিন্তু চ্যান্সেলর পদে ইউনিয়নের দাবি বছরকয়েক ধরেই দুর্বল হয়েছে।
এই পরিস্থিতি জার্মানির জন্য একেবারেই নতুন এক অভিজ্ঞতা। যার ফলাফলও অনেকটাই অনুমিত। সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলো বিশ্লেষণ করলে একটা বিষয় স্পষ্ট, জার্মানির আগামী ফেডারেল সরকারের অংশ হতে চলেছে গ্রিন পার্টি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন সামার্থ্যবলে? বায়েরবককে কোন ভূমিকায় বেছে নেবেন সাধারণ ভোটাররা? চ্যান্সেলর, নাকি নিছক ভাইস-চ্যান্সেলর? বায়েরবককে কি জার্মানরা চ্যান্সেলর হিসেবে কল্পনা করতে পারেন? গ্রিন পার্টি তাকে চ্যান্সেলরপ্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করলেও অনেক ভোটারের কাছেই তিনি অজানা কিংবা অপরিচিত। জার্মানির বর্তমান রাজনৈতিক গতিধারা চিন্তা করলে বিষয়টি আপাতত বায়েরবকের জন্য মাথাব্যাথার কারণ নাও হতে পারে। কারণ নতুন ধরনের নেতৃত্ব প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি কিন্তু এরইমধ্যে দিয়েছেন তিনি।
প্রথমত, প্রচারণার শক্ত চ্যালেঞ্জে উতরাতে হবে বায়েরবককে। পাশাপাশি পরাজিত করতে হবে লাশেট এবং শোলযকে। ২০১৭ সালের নির্বাচনে প্র্রচারণার প্রথম দিকেই ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিলেন এসপিডি’র প্রার্থী মার্টিন শুলয। শুরুতেই মের্কেলের জনপ্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ জানানো শুলযের শেষটা কিন্তু হয়েছিলো বড় পরাজয়ে। প্রচারণার দৌড়ে এগিয়ে থাকা শুলয নির্বাচনের ফলাফলে চলে যান পেছনের সারিতে। শুলযের মতোই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে আন্নালেনা বায়েরবককে।
এই চ্যালেঞ্জ কি উতরে যেতে পারবেন তিনি? বিরোধীদের সঙ্গে তুলনা করলে তার শক্তি এবং দুর্বলতার দিকগুলো কি কি? এই নির্বাচনে দলগুলোর ভূমিকা কি? আবারো কি কোনো জোট সরকার গঠন হতে চলেছে? সেক্ষেত্রে কি ধরনের জোট হতে পারে?
পারবেন বায়েরবক?
আন্নাবেলা বায়েরবক এরইমধ্যে এমন কিছু অর্জন করে ফেলেছেন, রাজনীতিতে যার নজির খুব একটা দেখা যায় না। আট বছরও পার হয়নি, নবীন একজন পার্লামেন্ট সদস্য থেকে আজ তিনি দলের চ্যান্সেলরপ্রার্খী। উত্থানের এই সময়টিতে অনেককেই পেছনে ফেলেছেন তিনি। অথচ মনোনয়নদৌড়ে হেরে যাওয়া দলের অন্য নেতারা নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করেননি তার বিরুদ্ধে।
বায়েরবকের এই যে উত্থান, এমনটা কিন্তু সাধারণত দেখা যায় না। রাজনীতির মাঠে বরং বিপরীতটাই দেখা যায় হরহামেশা। বিশেষ করে নেতৃত্বের দৌড়ে যিনি এগিয়ে থাকেন, তার বিরুদ্ধে নানা জল্পনা আর গুঞ্জন ছড়াতে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির। আর এগিয়ে থাকা ব্যক্তিটি যদি হয় নারী, অবস্থা হতে পারে আরো ভয়াবহ। যেমনটা মোকাবিলা করতে হয়েছিলো আঙ্গেলা মের্কেলকে। কোনো কোনো মহল থেকেতো তাকে ‘ব্ল্যাক উউডো’ ডাকা হয়। কারণ সিডিইউ’র মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় মের্কেল সবসময়ই তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাইডলাইনে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
বায়েরবককে নিয়ে অবশ্য দলের ভেতর থেকে নেতিবাচক এমন কিছুই ছড়ানো হয়নি। এর পেছনে একদিকে রয়েছে গ্রিন পার্টির দলীয় ঐক্য, অন্যদিকে বায়েরবকের চারিত্রিক দৃঢ়তা। ক্ষমতার প্রতি তীব্র মোহ থাকলেও নোংরা পথ কখনো বেছে নেননি তিনি। দলের মনোনয়নদৌড়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গ্রিন পার্টির কো-চেয়ারম্যান রবার্ট হাবেক। জার্মান পত্রিকা ‘ডি সাইট’কে দেয়া সাক্ষাতকারে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কথা খোলামেলাই বলেছিলেন হাবেক। বলেছিলেন, “জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে কাজ করার চাইতে বড় কোনো চাওয়ার আমার নেই।” এমন উচ্চাভিলাষ থাকার পরও প্রতিদ্বন্দ্বী বায়েরবক সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু ছড়াননি তিনি। এটাই গ্রিন পার্টির ঐক্য।
মের্কেলের সঙ্গে বায়েরবকের কাজের ধরনে কিন্তু অনেকটা মিল পাওয়া যায়। বায়েরবক সদাপ্রস্তুত, লক্ষ্যনির্ভর এবং নিজের চাওয়া সম্পর্কে পরিষ্কার। একইসাথে প্রয়োজনে যৌক্তিক ইস্যুতে আপোষ করতেও রাজি আছেন। এই বিশ্লেষণ কিন্তু গ্রিন পার্টির কোনো মিত্র করেননি। এটি করেছেন জার্মান রক্ষণশীলদের (সিডিইউ) সাবেক নেতা ভোলকার কাউডার। কাউডারের এই মন্তব্য শুনে মনে হয়, তিনি বুঝি আঙ্গেলা মের্কেলেরই বিশ্লেষণ করেছেন।
শ্রোতাদের উত্তেজিত করা কিংবা অনুপ্রাণিত করার মতো একজন দক্ষ বক্তা বায়েরবক। যদিও মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। চ্যান্সেলরপ্রার্থী হতে দলের মনোনয়নদৌড়ের শুরুতেই নতুন একটি ধারার প্রচলন করেছিলেন তিনি। যা ছিলো অনেক স্থির এবং নিয়ন্ত্রিত। যদিও নিজের সম্পর্কেই তাকে কখনো কখনো অনিশ্চিত মনে হতো। মনে হতো, অন্য কেউ হওয়ার চেষ্টা করছেন বায়েরবক। যেমনটা দেখা গিয়েছিলো আন্ড্রেয়া নাহলেসের ক্ষেত্রে। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এসপিডি’র নেতৃত্বে থাকা নাহলেসও এমনটাই করতেন। অনেকের মতেই, নাহলেস এতটাই উচ্চস্বরে কথা বলতেন, মনে হতো যে, তিনি ভীষণ অভব্য। তার ভাষণ শুনলে তাকে রোবোটিক মনে হতো। ফলে জনপ্রিয়তা হারান। কাজেই অন্য কেউ হওয়ার চেষ্টা না করে, বরং নিজের স্বকীয়তা ধরে রাখলে বায়েরবক সফল হতে পারেন।
৪০ বছর বয়সী বায়েরবক কখনো সরকারের অংশ ছিলেন না। এমনকি শীর্ষ কোনো প্রশাসনিক পদেও ছিলেন না তিনি। ঠিক এই জায়গাটিতেই শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে তাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, লাশেট এবং শোলযের বিপক্ষে লড়াইয়ে আগামী পাঁচ মাসের প্রচারণায় এই ইস্যুতে বারবার পরীক্ষা দিতে হবে তাকে।
আগামী কয়েকটি বছর একেবারেই আনকোড়া এবং মৌলিকভাবে ভিন্ন ধরনের কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে জার্মানিকে। সেই অভিজ্ঞতা জার্মানির জন্য বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে লাশেট জানেন, রাস্তায় কতজন পুলিশ কর্মকর্তাকে রাখতে হবে। শোলয জানেন ঘুমের ভেতরেও কিভাবে বাজেট লিখতে হয়। কিন্তু তাদের এই যোগ্যতা কি বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে সাহায্য করবে? যেটি হতে পারে আগামী নির্বাচনে ভোটারদের মূল ভাবনার বিষয়। এই ইস্যুতে নীতিপ্রণয়ন এবং কৌশলগত দিক থেকে অনেক এগিয়ে গ্রিন পার্টি। …………… (চলবে)